রাজাও সাহায্য চেয়েছিলেন

Haripada Bhowmick
রাজাও সাহায্য চেয়েছিলেন

    সেকালে যাঁরা দু-দশ টাকা আয় করতেন, তাঁদের বাড়িতে দোল-দুর্গোৎসব লেগেই থাকতো। দুর্গা, জগদ্ধাত্রী প্রভৃতি পুজোয় খরচ একটু বেশি বলে জমিদারগণই এই পুজোগুলো করতেন। সাধারণ মানুষ যে করতেন না তা নয়। জমিদারগণ কোনো একটি বিষয়ের বাৎসরিক আয় দুর্গোৎসবের জন্য রেখে দিতেন, এই আয় থেকেই পুজো হত। মুসলমান জমিদারের মধ্যেও অনেকে হিন্দু প্রজাদের মুখ চেয়ে দুর্গোৎসব করতেন। অনেক মুসলমান জমিদারিতে আগে হয়তো হিন্দুর বাস ছিল, পরে জমিদারি চলে যাওয়ায় পুরুষানুক্রমে হওয়া পুজো কিন্তু বন্ধ হতো না। প্রানকৃষ্ণ দত্ত তেমন এক পুজোর কথা শুনিয়েছেন, 'পূর্ণিয়া জেলায় কৃষ্ণগঞ্জ সবডিবিসনের মুসলমান জমিদারেরা আজিও তাঁদের কুতুবগঞ্জ বাজারটি দূর্গোৎসবের ব্যয়ের জন্য রাখিয়া দিয়াছেন। প্রতি বৎসর উক্ত বাজারে মহাসমারোহে দুর্গোৎসব হইয়া থাকে। আমরা একবার এই পূজার সময় উপস্থিত ছিলাম। এই স্থানে হিন্দু বাস নাই বলিলেও হয়, দলে দলে মুসলমান স্ত্রী-পুরুষ আসিয়া 'দুর্গো বিবি'কে দর্শন পয়সা দিয়া সেলাম করিয়া যায়।'

    জমিদারি প্রাপ্তির পর এক পুরুষ জমিদারিতে পয়সা আয় করেছে, পরের পুরুষ দু-হাত ভরে পয়সা খরচ করেছে। এক পুরুষ পুজো বাড়ির দুর্গাদালানে পুজোর ক'দিন ঝাড়বাতির নীচে বাঈ নাচিয়েছে, তিনদিন অগুনতি নিমন্ত্রিত, অ-নিমন্ত্রিত মানুষকে পেট ভরে খাইয়েছে, আশাতীত বাৎসরিক বিদায় পেয়ে ব্রাহ্মণগণ আশীর্বাদ করে বিদায় নিয়েছে। পরের পুরুষ বা কয়েক পুরুষ বাদে সেই বাড়ির দুর্গাদালানে দুর্গাপূজার সময় আলো পর্যন্ত জ্বলেনি। সেকালে এমনি বাড়ির সংখ্যা ছিল অসংখ্য। মহাসমারোহের মহাপূজাগুলো হঠাৎ কেন রাহুগ্রস্ত হল তা নিয়ে অনেকেই চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। অনেকেই রাহুগ্রস্ত কারণের উৎস সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত একটি সমীক্ষা রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের তারিখ ১৭ অক্টোবর ১৮২৯, পত্রিকার নাম 'সমাচার দর্পণ'। পত্রিকায় বলা হয়েছে, 'এই উৎসবের যে শোভা হইত তাহা রাহুগ্রস্ত হইয়াছে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। ইহার অনেক কারণ দর্শান যায়। কলিকাতাস্থ অনেক বড় বড় ঘর এখন দরিদ্র হইয়া গিয়াছে যাঁহারা ইহার পূর্ব্বে মহাবাবু এবং সকল লোকের মধ্যে অতিশয় প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে অনেকেরই এখন সেই নামমাত্র আছে।'

    এইসব কারণ ছাড়া আরও নানা কারণে নববাবু বা জমিদারগণ দরিদ্র হয়ে গিয়েছিলেন, এবং তখন তাঁরা বাধ্য হয়েই সমস্ত ক্রিয়াকর্ম বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কোনো জমিদার দরিদ্র হয়ে সাহায্য নিয়ে কোনো কাজ বিশেষ করে দুর্গোৎসব করেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। গঙ্গাধরচন্দ্র দেবস্য নামে কোনো এক রাজা ১৮৬৮ খ্রীস্টাব্দে কাশিমবাজারের মহারানী স্বর্ণময়ীকে একটি চিঠিতে অর্থাভাবে দুর্গোৎসব হচ্ছে না, সাহায্যের প্রয়োজন জানান। গঙ্গাধর নিজেকে বাজপেয়ি রাজা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি কোথাকার রাজা বা জমিদার তা চিঠি থেকে জানা যায়নি, মহারানীকে 'শারদিয়া' বলে সম্বোধন করেছেন। হরিপদ ভৌমিকের সংগ্রহ থেকে চিঠিটি নিচে দেওয়া রইল ঃ

(মূল চিঠি)

শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়―
    বাজপেয়িরাজা শ্রীগঙ্গাধরচন্দ্র দেবস্য

শারদিয়া―
    তদীয়স্য বাজপেয়িনঃ পরমাসীষ নীধং বিজ্ঞপনঞ্চ বিশেষ।―শ্রীমত্যা মহারানির মঙ্গলোন্নতী সতত চিন্তনীয়া যাহাতে অত্রানন্দ।―এক্ষণকার অবস্থানুসরে শ্রীশ্রীমহাপূজা যে বিসয়ের উপসত্ত হইতে নির্ব্বাহ হইত বর্তমান সনে পৌত্রীক দেনায় ডিক্রীদার ঐ বিসয়টি ডিক্রী জারিতে ক্রোক করিয়াছে, সেহেতু মপস্বল আদায় তহবিল বন্দ, এক্ষণে উক্ত পূজার দিন অতি শঙ্খেপ, নির্ব্বাহ হইবার আর অন্য উপায় নাই―পুরুসানুক্রমে পূজাদী বাদ যায় নাই পূজাখানি বাদ হইলে জীবৎমৃত্যুবৎ মহারানির সরকার ভিন্য অস্মদাদীর জানাইবার স্থানাভাব মহারানির কল্যানে জাহাতে পূজাখানি নির্ব্বাহ হয় তৎ-সাহায্য প্রার্থিত বিধায় এখানকার কর্ম্মচারি শ্রীযুত দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠাই আর সকল বাচনিকে জ্ঞাত করাইবেন অত্রস্থ রাজধানির কাইক মঙ্গল তথাকার রাজধানির মঙ্গলাদি লিখিয়া সন্তোষ করিবেন মিতি সন ১২৭৫ তারিখ ১৬ শ্রাবণস্য।

                                                     শ্রী―

    চিঠি প্রাপ্তির পর মহারানী গঙ্গাধরকে কত টাকা সাহায্য পাঠিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। তবে বাড়ির দুর্গোৎসবে টাকার প্রয়োজনে মহারানী স্বর্ণময়ী যে অর্থসাহায্য করতেন তা ১৮৭৮ সনে ১৪ আগস্ট তারিখে প্রেসিডেন্সি বিভাগের কমিশনার মিঃ পিকক সাহেবের বক্তৃতা থেকে জানা যায়। স্বর্ণময়ীকে একটি সরকারি খেতাব দান উপলক্ষে পিকক সাহেব বলেন, 'দুর্গাপূজা উপলক্ষেও তিনি সমগ্র বাঙ্গালার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতবর্গকে মূল্যবান দান ও দক্ষিণা দেন, তার সঙ্গে থাকে ব্রাহ্মণ ও কাঙালী ভোজন। স্বগৃহে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের জন্য যে সকল ব্রাহ্মণ এই ধর্মপ্রাণা মহিলার অর্থসাহায্য প্রার্থনা করেন, তিনি তাঁদেরও যথোপযুক্ত অর্থসাহায্য দান করেন।' সাধারণ মানুষ সাহায্য চেয়ে মহারানীর কাছে হাত পাততে পারেন, কিন্তু একজন রাজা বা জমিদার হয়ে অন্যের কাছে হাত পেতে সাহায্য নিয়ে দুর্গোৎসব করবেন এটা অভাবনীয়। গঙ্গাধরচন্দ্রই সম্ভবত প্রথম রাজা, যিনি দুর্গোৎসবের জন্য অন্য রাজবাড়ীর দ্বারস্থ হয়েছেন।

--------------------------------------------

তথ্যসূত্র ঃ

হরিপদ ভৌমিক

No comments

Powered by Blogger.