তখন কলকাতার বর্ষাকাল




‘পাঠকগণের স্মরণ থাকিবে গত বৃহস্পতিবার রাত্রি ১১টার সময়ে বৃষ্টি আরম্ভ হয়, আর যখন আমরা ঘুম থেকে উঠিলাম তখনও দেখি যে জল পড়িতেছে। চিতপুরের রাস্তায় আসিয়া খিল খিল করিয়া হাসিতে ইচ্ছা হইল। রাস্তা কি পদ্মা নদী তাহা বুঝিয়া ওঠা ভার।' সংবাদটি পড়ে বর্তমান কলকাতার চিত্র মনে হলেও, এটি শতবর্ষ আগের সংবাদ। সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল ১২৭৮ সনের ৩১ জ্যৈষ্ঠ 'সুলভ সমাচার' পত্রিকায়। সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘কলিকাতার রাস্তায় নৌকা চলে'। এই সংবাদ পড়ার পর, কোটি-কোটি টাকা খরচ করে কলকাতার উন্নয়ন হয়েছে এ-কথা কি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে?

    একশো বছর আগে স্কুলে ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে মায়ের যে চিন্তা, জল জমা আজকের কলকাতার মায়েদেরও ঠিক সেই চিন্তা। ১২৭৮ সনের ২৪ জ্যৈষ্ঠ তারিখে প্রকাশিত ‘জলে জলে একাকার' সংবাদ থেকে অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি, 'ছোট ছোট ছেলেদের ইস্কুলে যাইবার সময় কিংবা বাটী আসিবার সময় মেঘ ডাকিলেই বিপদ। রাস্তায় তাহাদের ডুবু জল। ছেলে ইস্কুলে থাকিলে যদি জল হয়, অমনই তাহার গর্ভধারিণীর মুখ শুকাইয়া যায়। একদৃষ্টে পথের দিকে চাহিয়া থাকেন, এবং মনে করিতে থাকেন বাছাটি ভালয় ভালয় বাড়ি আসিলেই নিশ্চিন্ত হই। কর্তার মুখে শুনিয়াছি পথে যেরূপ জল দাঁড়ায় তাহাতে মায়ের মন ভয়ে কাঁপিতেছে। বাস্তবিক বৃষ্টির সময় পথে চলা ভয়েরই কার্য। নর্দ্দামা রাস্তার সঙ্গে এক হইয়া যায়। একটুকু এদিক ওদিক হলেই সর্বনাশ।

kolir sohor kolkata
সুলভ সমাচার

       ট্যাক্স বাড়বে কিন্তু কাজ বাড়বে না—এটা যেন সর্ব যুগের কলকাতা কর্পোরেশনের বৈশিষ্ট্য। খুব দুঃখের সঙ্গে সেকালের পত্রিকায় লেখা হত, ‘একেই কি বলে নগরের শ্রীবৃদ্ধি, ইহার জন্যই কি ট্যাক্সের এত পীড়াপীড়ি? ..নর্দ্দামা আর পরিষ্কারও হয় না, পূর্ব্বের মত ধাঙ্গড়ও দেখিতে পাওয়া যায় না, বোধ হয় পরিমিত ব্যয়ী মিউনিসিপ্যালিটি এই বাজে খরচটি কমাইয়া দিয়াছেন। যেখানে মিউনিসিপ্যালিটির হাত সেখানে ভরাডুবি—রাস্তাগুলি বৃষ্টিৱ সময় ডুবু ডুবু, অন্য সময় লুটোপুটি।'

     কলকাতার বর্ষা নিয়ে যে কত জল ঘোলা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কত টাকা যে জলে গেছে তারও হিসেব-নিকেশ নেই। সবটাই যেন জুয়ায় হেরে যাওয়ার মতো অবস্থা, হেরে গেছি, করার কিছু নেই-গোছের মানসিকতা। মনে করা যেতে পারে একশো বছর ধরে বর্ষার কলকাতাকে জলমুক্ত করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলেছেন, এবং হেরে গিয়ে কলকাতার ভাগ্যকে দোষারোপ করছেন।

    বললে অবাক হবেন, সত্যি-সত্যি কলকাতার বর্ষা নিয়ে জুয়াও খেলা হয়। এই তো সেদিন অকাল বর্ষণে কলকাতা ভেসে গিয়ে সর্বত্র জল দাঁড়িয়ে যায়। পাড়ার সাট্টার টেবিলের ছেলেরা টেবিল ছেড়ে জলের উপর বাজি ধরে। রাস্তার হাঁটু জল পাতালে গেলে অর্থাৎ পাতাল রেলে ঢুকলে কত জল দাঁড়াবে তার উপর বাজি। এর ফল দেখতে খুলে দিতে হল পাতাল রেলে জল ঢোকার মুখ। বাজির ফলাফল নির্ণয় হলো বটে, পাতাল রেলের ক্ষতি হল কোটি কোটি টাকার। কলকাতার বর্ষার জল নিয়ে জুয়াখেলা নতুন মনে হতে পারে, কিন্তু নতুন নয়। শতবর্ষ পূর্বে এই হুজুগ সার্বজনীন রূপ পেয়েছিল। সে এক মজার ব্যাপার। বড়বাজারের তৎকালীন অফিসের চৌরাস্তার কাছে, 'দুই একটা খুব উচ্চ পুরাতন বাড়ি আছে, উহার নৰ্দ্দামার দিকেই সকলে (দুই শত পাঁচ শত খোট্টা) একদৃষ্টে তাকাইয়া থাকে। একদল বাজি রাখে পাঁচ ঘন্টার মধ্যে বৃষ্টি হইবে যে ঐ বাড়ির নৰ্দ্দামা দিয়া হু হু শব্দে জল পড়িবে। আর একদল ইহার বিপরীত বলে। দুই আনা অবধি দুই শত পাঁচ শত টাকা পর্যন্ত এই খেলায় বাজি চলে।' এই লক্ষ্মীমন্ত ও লক্ষ্মীছাড়া হওয়ার বর্ষা-বাজিকে সুলভ ‘মাড়য়ারি মর্ষম' আখ্যা দিয়েছেন। চাতক পাখির মতো এরাও জল জল বলে আকাশ পানে চেয়ে থাকেন। এই জুয়ার বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে ১৭ শ্রাবণ ১২৭৮ তারিখের ‘সুলভ সমাচার' লেখেন, 'নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বৃষ্টি পড়িলে খোট্টা মাড়য়ারীরা এমনই চিৎকার করিয়া ওঠে যে, গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত হইবার সম্ভাবনা। আধ ক্রোশ দূরের লোকও ঐ শব্দ শুনিতে পায়। ষণ্ডামার্কা গুলা প্রাণপনে চেঁচায় কেহ বাজি জিতিয়াছে বলিয়া আনন্দে করতালী দিয়া নাচিতে থাকে, কেহ টাকা গেল বলিয়া ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদে। পুলিশের লাল পাগড়ীওয়ালা... ভায়ারাও এই জুয়া খেলার কথা কলকাতা বিলক্ষণ জানেন ...আমরা তো গভর্নমেন্টের এবং পুলিশের ব্যবহার দেখিয়া শুনিয়া অবাক হইয়া পড়িয়াছি।'

     কলকাতায় বর্ষার জল জমা, সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে মায়ের ভীতি, কর্পোরেশনের নীতি, বর্ষা-জুয়া, সবই একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন বর্ষা-চিত্র টাকার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। এক-পিঠ শতবর্ষ আগের, অন্য-পিঠ বর্তমানের। চেহারা একই।

তথ্যসূত্র ঃ

হরিপদ ভৌমিক




No comments

Powered by Blogger.