সেকালের রথযাত্রা

সেকালের রথযাত্রা

শুভঙ্কর মাজি

সেকালের রথযাত্রা
সেকালের রথযাত্রা

'রথযাত্রা'র কথা বললে প্রথমেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে শ্রীক্ষেত্র পুরীর ঐতিহ্যপূর্ণ রথযাত্রার ছবি। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে রথোৎসব পালিত হলেও পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রাই হলো প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম। রথযাত্রা যেমন উড়িষ্যার বিখ্যাত উৎসব, তেমনই বাংলায় এই উৎসবও মহা ধূমধাম করে পালিত হয়। অতীতে ফিরে তাকালেই আমরা দেখব―যেখানে রাধাকৃষ্ণের মন্দির এবং যেখানেই অধিক স্বচ্ছলতা, সেখানেই রথযাত্রা। বাংলার সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী রথগুলির মধ্যে শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের রথ, মহিষাদলের রথ, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের পারিবারিক রথ অর্থাৎ নৈহাটির কাঁঠালপাড়ার রথ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
  প্রাচীনতা ও ঐতিহ্যের দিক থেকে পুরীর রথযাত্রার পরেই মাহেশের স্থান। ১৩৯৬ সাল থেকে হুগলীর শ্রীরামপুরে এই রথোৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
  মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রার নেপথ্যে একটি জনশ্রুতি রয়েছে। শোনা যায়, চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়ে তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে তিনি জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা বাঁধা দেওয়ায় তিনি তা করতে পারেননি। এই দুঃখে ধ্রুবানন্দ অনশন ক'রে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন বলে ঠিক করেন। অনশনের তৃতীয় দিনে ধ্রুবানন্দ স্বপ্নাদেশ পান বাংলাতে ফিরে গিয়ে হুগলী নদীর ধারে মাহেশ বলে একটা জায়গায় জগন্নাথ মন্দির স্থাপন করার। এই স্বপ্নাদেশ পেয়ে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করেন। একদিন মাহেশের ঘাটে স্নান করতে গিয়ে তিনি একটি ভেসে আসা নিমকাঠ দেখতে পান। জল থেকে সেই নিমকাঠ তুলে এনে দেবতার মূর্তি বানিয়ে তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ১৭৫৫ সালে কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে জগন্নাথদেবের মন্দির তৈরি করেছিলেন, যা আজও রয়েছে।
  মাহেশের প্রথম রথ কে নির্মাণ করেছিলেন, তা আজও জানা যায়নি। তবে বেশ কয়েকবার এই রথের পরিবর্তন হয়েছে। ১৭৯৩ সালে শ্যামবাজার নিবাসী কৃষ্ণরাম বসু একটি সুদৃশ্য কাঠের রথ নির্মাণ করিয়ে দেন। কালক্রমে এই রথটি জীর্ণ হয়ে পড়লে কৃষ্ণরাম বসুর পুত্র গুরুপ্রসাদ বসু একটি নতুন রথ বানিয়ে দেন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে এই রথটিও নষ্ট হয়ে যায়। এরপর ১৮৫২ সালে কালাচাঁদ বসু পুনরায় একটি নতুন রথ নির্মাণ করিয়ে দেন। শোনা যায়, এই রথে এক জনৈক ব্যক্তি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ফলে এই রথটিও অপ্রবিত্র জ্ঞানে বাতিল করা হল। পুনরায় ১৮৫৬ সালে বিশ্বম্ভর বসু আরও একটি নতুন রথ নির্মাণ করিয়ে দিলেন। কিন্তু জগন্নাথদেবের এমনই কপাল যে, ১৮৮৪ সালে এই রথটিও আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়। এরপর দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসুর উদ্যোগে মার্টিন-বার্ন কোম্পানির কারিগরি সহায়তায় ১৮৮৫ সালে তৈরি হল ৫০ ফুট উচ্চ লোহার রথ। রথটিতে রয়েছে মোট ১২টি লোহার চাকা ও দুটি তামার ঘোড়া। সে যুগে এই রথটি নির্মাণ করতে কৃষ্ণচন্দ্র বসু মোট ২০ হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন। এখনও এই রথটিই বর্তমান।
  ১৮১৮ সালে মাহেশের রথের সময় খুব বৃষ্টি হয়; রাস্তা নূতন নির্মিত হয়েছিল, তাই রথ বেশিদূর টানা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে ১৮১৮ সালের ১১ জুলাই (২৮ আষাঢ়, ১২২৫) 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় লেখা হয়―"প্রতি বৎসর রথ চলিতেছে কিন্তু এ বৎসরে রথ চলন স্থানে নূতন রাস্তা হওনে অধিক মৃত্তিকা উঠিয়াছে এবং অতিশয় কৃষিপ্রযুক্ত কর্দম হইয়াছে তাহাতে রথ কতকদূর আসিয়া রথের চক্র কর্দমে মগ্ন হইল কোন প্রকারেও লোকেরা উঠাইতে পারিল না শেষে লোকযাত্রা ভঙ্গ হইল ইহাতে রথ চলিল না। ... রথ না চলাতে অনেকের অনেক ক্ষতি হইল। যে ব্যক্তি বাজার ইজারা করিল এবং যে ব্যক্তি ঠাকুরের মন্দির ইজারা করিল তাহারদিগের লাভ কিছুমাত্র হইল না এবং দোকানী পসারী কলিকাতা হইতে এবং অন্য২ স্থান হইতে আসিয়াছে তাহারদিগেরও সামগ্রী বিক্রয় না হওয়াতে যথোচিত ক্ষতি হইল।"
  প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানতে পারি―"মাহেশের রথ দেখবার জন্য কলকাতা থেকে অনেকে ভাউলে, পানশি করে, সেজেগুজে আমোদ করতে যেতেন। ... কলকাতার অনেক 'বাবু' বজরানৌকা ঝাড়লণ্ঠনে সাজিয়ে বাইজী খেমটা নাচ-গান খাওয়া-দাওয়া করতে করতে মাহেশে যেতেন।"
  অতীতের সে ঔজ্জ্বল্য না থাকলেও মাহেশের রথোৎসব আজও বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় মেলা। নগরায়ণের চাপে এই মেলার পরিসর অনেকটাই কমে গিয়েছে। তবু রথযাত্রা উপলক্ষে এখনও হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে ওঠে মাহেশে।
  নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের পারিবারিক রথও ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৮৬২ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় মা দুর্গাসুন্দরীর নামে এই রথোৎসব শুরু করেন। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কুল-দেবতা বিজয় রাধাবল্লভ জিউ, তাঁকে কেন্দ্র করেই এই রথযাত্রার শুরু।
  এই রথ উপলক্ষে সেকালে যেরূপ জাঁকজমক হত, শ্রদ্ধেয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখায়―"রথের সময় বঙ্কিমবাবুদের বাড়ির দক্ষিণে একটা খোলা জায়গায় বেশ একটি মেলা হয়; প্রচুর পাকা কাঁটাল ও পাকা আনারস বিক্রি হয়, তেলেভাজা পাঁপর ও ফুলুরির গাঁদি লাগিয়া যায়, আট-দশখানা বড়ো বড়ো ময়রার দোকান বসে, গজা, জিলিপি, লুচি, কচুরি, মিঠাই, মিহিদানা, মুড়িমুড়কি, মটরভাজা, চিঁড়ে, চিঁড়েভাজা যথেষ্ট থাকে। আগে ঘিয়োর ও খাজা থাকিত; এখন আর সেগুলি দেখিতে পাওয়া যায় না।"
  শুধু তেলেভাজা ও ময়রার দোকান নয়, মনিহারি দোকানেরও পসরা সেজে উঠত―"মেলায় মনিহারি দোকান অনেকগুলি থাকে। তাহাতে নানা রকম বাঁশি, কাগজের পুতুল, কাঠির ওপর লাফ-দেওয়া হনুমান, কট্‌কটে ব্যাঙ কিনতে পাওয়া যায়। যে সব তো গেল ছেলেদের। বুড়োদের একটি বড়ো দরকারি জিনিস এই মেলায় বিক্রি হয়―নানা রকম গাছের চারা ও কলম। ... অনেক নারিকেলের চারা, আমের কলম, নেবুর কলম, সুপারির চারা, লকেট ফলের গাছ, গোলাপজামের গাছ, পিচের গাছ, সবেদার গাছ, ফল্‌সার গাছ এবং গোলাপ, জুঁই, জাতি, বেল, নবমালিকা, কামিনী, গন্ধরাজ, মুচুকুন্দ, বক্, কুর্‌চি, কাঞ্চন, টগর, শিউলি প্রভৃতি নানা ফুলের চারা ও কলম পাওয়া যায়।" যাঁরা বাগান করতে চাইতেন―তাঁদের জন্য রথযাত্রাই ছিল চারা কেনার প্রধান সুযোগ।
শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখা থেকে আরও জানতে পারি―কাঁঠালপাড়ার রথযাত্রায় পুতুল নাচের খুব ভালো ব্যবস্থা ছিল। প্রকাণ্ড এক দোচালার মধ্যে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ রকমের পুতুল নাচ হত। সীতার বিবাহ, লবকুশের যুদ্ধ, কালীয়দমন―এসবই ছিল এই রথের মূল আকর্ষণ। এমনকি সেই সময় এই রথযাত্রা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে রথের সময় বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করত। আট দিন ধরে বসত রথের মেলা। সেই প্রথা আজও অব্যাহত।

এবার আসা যাক কলকাতার রথযাত্রায়। সেকালে কলকাতার রথযাত্রার একটি সুন্দর বর্ণনা অঙ্কিত হয়ে রয়েছে হুতোমের লেখায়―
"রথের দিন চিৎপুর রোড্ লোকারণ্য হয়ে উঠ্‌লো,―ছোট ছোট ছেলেরা বার্নীস করা জুতো ও সেপাইপ্যেড়ে ঢাকাই ধুতি পোরে, কোমরে রুমাল বেঁধে, চুল ফিরিয়ে, চাকর চাক্‌রাণীদের হাত ধরে পয়নালার ওপোর পোদ্দারের দোকানে ও বাজারের বারাণ্ডায় রথ দেখ্‌তে দাঁড়িয়েছে। আদ্‌বইসি মাগিরা খাতায় খাতায় কোরা ও কলপ দেওয়া কাপড় পোরে রাস্তা যুড়ে চলেচে; মাটীর জগন্নাথ, কাঁঠাল, তাল্‌পাতের ভেঁপু, পাখা ও সোলার পাখি বেধড়ক বিক্রী হচ্চে; ছেলেদের দ্যাখাদেখি বুড়ো বুড়ো মিন্‌সেরাও তালপাতের ভেঁপু নিয়ে বাজাচ্চেন; রাস্তায় ভোঁ পোঁ ভোঁ পোঁ শব্দের তুফান উঠেচে―ক্রমে ঘণ্টা, হরিবোল, খোল, খত্তাল ও লোকের গোলের সঙ্গে অ্যাকখানা রথ এলো―রথের প্রথমে পেটা ঘড়ি, নিশান, খুন্তি, ভোড়োং ও নেড়ির কবি; তারপর বৈরাগীদের দু তিন দল নিমখাসা কেত্তন; তার পেছনে সকের সংকীর্ত্তন গাওনা।"
  বাংলার অন্যান্য স্থানের মতো ব্রিটিশ আমলে কলকাতাতেও খুব ধুমধাম করে রথযাত্রা হত। জাতি-ধর্ম, কুল-পদমর্যাদা, উচ্চ-নীচ এসব ভেদাভেদের তোয়াক্কা না করে কাতারে কাতারে মানুষ এসে ভিড় জমাতেন শহরের রাস্তায়। কলকাতার অন্যান্য পূজা-পার্ব্বণের মতো রথোৎসবকে 'বাবু'রা খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না; কারণ রথের সামনে তো আর বাঈ নাচানো যায় না! মদের ফোয়ারাও ওড়ানো যায় না! তবু এই উৎসবটিকেও তাঁরা বাদ দিতেন না। তাই হুতোম মজা করে বলেছেন―"এতে ইয়ারকির লেশমাত্র নেই, সুতরাং সহরে রথ পার্ব্বণে বড় অ্যাক্‌টা ঘটা নাই; কিন্তু কলিকাতায় কিছু ফাঁক যাবার নয়।"
কলকাতার প্রসিদ্ধ রথের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল―শোভারাম বসাকের রথ, মাড়েদের রথ, মানিকচন্দ্র বসুর রথ, পাইকপাড়ার লালাবাবুদের রথ, চোরবাগানে মল্লিকদের রথ, বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর রথ, জোড়াবাগানে ঘোষেদের রথ, গোবিন্দ সেন লেনে চুনিমণি দাসীর রথ প্রভৃতি। দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও খুব ঘটা করে রথযাত্রা হত।
  শোভারাম বসাক ছিলেন পুরোনো কলকাতার নামকরা ব্যবসায়ী বাসিন্দা। তাঁদের কুলদেবতা গোবিন্দ জীউ অধিষ্ঠিত ৭০ ফুট উঁচু রথ বেরুত বউবাজারের রাস্তায়। বৈঠকখানা থেকে লালদিঘি অবধি বিস্তৃত অঞ্চলে এই রথ টানা হত। রথের পিছনে ব্রাহ্মণ, পুরোহিত,  গাঁ-গঞ্জের মানুষজনে ছয়লাপ হয়ে থাকতো পথঘাট।
  কলকাতায় মাড়েদের রথ হল, জানবাজারে রাণী রাসমণির রথ। এই রথকে মাড়েদের রথ বলার কারণ―রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্র দাসের পিতা প্রীতিরাম দাস বাঁশের ব্যবসা করতেন। সেকালে অনেকগুলো বাঁশ একসঙ্গে বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে আনা হত। একেই চলিত কথায় 'বাঁশের মাড়' বলা হয়। সেই থেকেই প্রীতিরাম 'মাড়' নামক ব্যবসায়গত উপাধি লাভ করেন। এবং সাধারণ মানুষও এদের 'মাড়' নামে চিনতেন। 
  মাড়েদের রথটি ছিল রুপো দ্বারা নির্মিত। এই রথটি নির্মাণ করতে সেসময় খরচ হয়েছিল ১ লক্ষ ২২ হাজার ১১৫ টাকা। রথযাত্রা উপলক্ষে তিন মণের মতো জুঁই ফুল কেনা হতো রথটিকে সাজানোর জন্য। রথের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় জাত-পাত ভুলে অসংখ্য মানুষ এসে সামিল হতেন। স্বামী জগদীশ্বরানন্দ জানান―"প্রতি বৎসর ৪/৫ শত লোক রথ-রজ্জু ধরিয়া টানিতেন।" শতাধিক বাদ্যকর ও শত শত গায়কের গানে মুখরিত হয়ে উঠত কলকাতার রাজপথ। বর্তমানে এই রথযাত্রাটি হয় রাণী রাসমণির স্মৃতি বিজড়িত দক্ষিনেশ্বর কালীমন্দিরে।
  এছাড়াও সেকালে কলকাতার ছোট বড় অসংখ্য রথ পথে বের হত। রথযাত্রা ঘিরে মেলাও বসত বহু জায়গায়। সেই মেলা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আসতেন কলকাতায়। এমনকি মেলার ভিড়ে বহু ছেলে-মেয়েই হারিয়ে যেত। ঈশ্বর চন্দ্র দেব নামে এক ব্যক্তি ১১ জুলাই ১৮৫৯ (২৮ আষাঢ় ১২৬৬) তারিখে 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছেন―তাঁদের বাড়ীর চাকর তাঁর ভাইকে নিয়ে রথ দেখতে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাড়ী ফিরে আসেনি। কোনো ব্যক্তি তাদের সন্ধান দিতে পারলে তিনি তাঁকে পুরস্কৃত করবেন। সম্পূর্ণ বিজ্ঞাপনটি নীচে দেওয়া রইল―
'বিজ্ঞাপন।
গত ১৯ আষাঢ় রথ দেখা উপলক্ষে আমারদিগের বাড়ীর চাকর আমার ভ্রাতাকে লইয়া কোথায় গিয়াছে, তাহার উদ্দেশ্য না হওয়াতে নিম্নে অবয়ব ও নাম প্রকাশ করিতেছি, কেহ সন্ধান করিয়া ভবানীপুরে শ্রীযুত দুর্গাপ্রসাদ রায় চৌধুরী মহাশয়ের বাটীতে আমার নামে সমাচার দিলে পুরস্কৃত হইবেন।
ঈশ্বরচন্দ্র দেব।
ভ্রাতা শ্রীউমেশচন্দ্র ঘোষের বয়ঃক্রম ৮/৯ বৎসর, শ্যামবর্ণ দোহারা।
গোবিন্দচন্দ্র উড়ে নিবাস সর**পুর জেলা মেদিনীপুর, বয়ঃক্রম ৩৫/৩৬ বৎসর, শ্যামবর্ণ, ঘাড় কুঁজো, নাক লম্বা।'
  শুধু তাই নয়, মেলার ভিড়ে পড়ে গিয়ে বহু মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটত। এই প্রসঙ্গে 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় 'রথ' শিরোনামে লেখা হয়―
"১১ আষাঢ় ২৪ জুন বৃহস্পতিবার মোং কলিকাতার পটোল ডাঙ্গায় যে ব্যক্তি রথ করিয়াছিল তাহার ভ্রাতুপুত্র রথ চাপনে মারা পড়িয়াছে। ললোকের ভিড়ে সে ব্যক্তি পড়িলে রথ তাহার উপর দিয়া গেল তাহাতে তাহার হাত পা ও পাঁজরা ভাঙ্গিল পরে তাহাকে চিকিৎসালয়ে লইয়া গেল চিকিৎসক অনেক চেষ্টা করিল তাহাতে সেদিন জীবৎ ছিল পরদিন সে মরিল।
এবং বহুবাজারে এক ব্যক্তি কুম্ভকার রথের নীচে পড়িয়াছিল তাহাতে তাহার এক পা মাত্র ভাঙ্গিয়াছে। অনুমান হয় যে সে বাঁচিতে পারে।
আর এক বালকও পড়িয়াছিল কিন্তু সে রথের চাকার মধ্যে ২ যে স্থান আছে সেখানে রহিয়া সে বাঁচিয়াছে।"
  তবে সব ক্ষেত্রেই তা অনিচ্ছাকৃত বা এরূপ দুর্ঘটনা ঘটত না। ধর্মান্ধ জনতার কিছু অংশ মনে করত―রথের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করলে সমস্তরকম পাপের মুক্তি ঘটবে এবং অক্ষয় স্বর্গবাস হবে। এরকম ভ্রান্ত ধারণায় রথের সময় বহুলোকের জীবনাবসান ঘটত।
  কোনো কোনো স্থানে রথের মেলায় হরেক রকম দোকান-দানির পাশাপাশি জুয়া খেলার আড্ডাও চলত সমান তালে। দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর মানুষ জুয়া খেলার লোভে রথের মেলায় আসতেন। এই খেলায় এক পক্ষের লাভ হলে ওপর পক্ষের লোকসান হত। মাহেশের রথের মেলাতেও জুয়ার আসর জমে উঠত। এবং এই জুয়ার নেশা যে কতটা মারাত্মক―তা জানা যায় 'সমাচার দর্পণে'র একটি সংবাদের মাধ্যমে। ১৯শে জুন ১৮১৯ (৬ আষাঢ় ১২২৬) তারিখে 'রথযাত্রা' শিরোনামে 'সমাচার দর্পণে' লেখা হয়―"১১ আষাঢ় ২৪ জুন বৃহস্পতিবার রথযাত্রা হইবেক। ... ঐ যাত্রার সময়ে অনেক স্থান হইতে অনেক ২ লোক আসিয়া জুয়াখেলা করে ইহাতে কাহারো ২ লাভ হয় ও কাহারো ২ সর্ব্বনাশ হয়। এইবার স্নানযাত্রার সময়ে দুই জন জুয়া খেলাতে আপন যথাসর্ব্বস্ব হারিয়া পরে অন্য উপায় না দেখিয়া আপন যুবতী স্ত্রী বিক্রয় করিতে উদ্যত হইল এবং তাহার মধ্যে একজন খানকীর নিকটে দশ টাকাতে আপন স্ত্রী বিক্রয় করিল। অন্য ব্যক্তির স্ত্রী বিক্রীতা হইতে সম্মতা হইল না তৎপ্রযুক্ত ঐ ব্যক্তি খেলার দেনার কারণ কএদ হইল।"
  এখনও মফস্‌সলের দিকে কোনো কোনো রথের মেলায় জুয়া খেলার চল রয়েছে। তবে তার পরিণতি সেকালের মতো এতটাও মারাত্মক নয়। 

সেকালে কলকাতার 'বাবু'রা মদ ছাড়া কোনো উৎসবের কথা ভাবতেই পারতেন না। কিন্তু অন্যান্য উৎসবের মতো রথযাত্রায় সেভাবে মদ-মহোৎসব হত না বললেই চলে। তবু উৎসব পালন উপলক্ষে যাঁরা দু' এক পাত্র চড়াতেন, তাঁরা সম্পূর্ণই বে-এক্তিয়ার হয়ে পড়তেন। সর্বাঙ্গ পেরেকখচিত কাঠের ঘোড়া লাগানো দারুময় রথটিকে দেখে তখন একটি মাতৃপ্রতিমার মত মনে হত। অতঃপর তাঁর মুখ দিয়ে মাতৃবন্দনার যে পদটি বেরিয়ে আসত, তা হুতোমের লেখা থেকে জানতে পারি―
"কে মা রথ এলি?
সর্ব্বাঙ্গে পেরেক মারা চাকা ঘুর্‌ ঘুরালি।
মা তোর সাম্‌নে দুটো ক্যেটো ঘোড়া,
চুড়োর উপর মুক্‌পোড়া,
চাঁদ চামুরে ঘন্টা নাড়া,
মধ্যে বনমালী।
মা তোর চৌদিকে দেবতা আঁকা
লোকের টানে চল্‌চে চাকা,
আগে পাছে ছাতা পাকা,
বেহদ্দ ছেনালী।"

রথযাত্রার দিনটিকে বাঙালিরা একটি পুণ্যতিথি ব'লে মনে করত এবং এখনও করে। এই দিন নানারকম শুভকার্য্যের সূচনা হয়। যেমন―গৃহনির্মাণ, গ্রন্থরচনা, কবিগানের বায়না, যাত্রা, কথকতা ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি―১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে রথযাত্রার দিনেই শুরু হয়েছিল শিয়ালদহ-রানাঘাটের মধ্যে ট্রেন চলাচল। এমনকি সরকারী দপ্তরগুলিও এই দিনটিকে মান্যতা দিত। ৭ই জুলাই ১৮৩১ (২৪ আষাঢ় ১২৩৮) তারিখে 'সমাচার চন্দ্রিকা'য় রথযাত্রা উপলক্ষে অফিস বন্ধের একটি নোটিশ প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপনটি নিম্নরূপ ―
"কোম্পানীর অফিস বন্ধ।
আগামী ১১ জুলাই সোমবার রথযাত্রা হইবেক তজ্জন্য কোম্পানির ত্রেজারি প্রভৃতি তাবৎ অফিস বন্ধ হইবেক এবং ঐ দিবস কোন কর্ম্ম হইবেক না―"

যেরূপ ধুমধাম করে সেকালে রথযাত্রা পালিত হত, তা আর হয়না বললেই চলে। গ্রাম বাংলা সহ শহর কলকাতার বিভিন্ন স্থানে এখনও রথোৎসব উপলক্ষে মেলা বসে, তবে অতীতের সেই ঔজ্জ্বলতা আজ আর নেই। এখন বেশিরভাগ স্থানে মেলা শুরু হয় সন্ধ্যের পর। সেকালে কিন্তু সন্ধের মধ্যে রথ টানা ও রথের মেলা শেষ হয়ে যেত। সন্ধ্যা নেমে এলে ধীরে ধীরে মেলার ভিড় কমে আসত। গ্যাস জ্বালা মুটেরা দ্যাখা দিতেন মই কাঁধে করে। দোকানীরা দোকান-পাট গুটিয়ে ফেলতেন। দর্শকেরাও ফিরে যেতেন যে যার ঘরে।

তথ্যসূত্র :
―――――
১. সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা । (অরুণ নাগ সম্পাদিত)
২. বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গ । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
৩. পুরোনো কলকাতার রথযাত্রা । হরিপদ ভৌমিক (২৩ জুন, ১৯৭৯ সালে 'পুরশ্রী' পত্রিকায় প্রকাশিত)
৪. বাবু গৌরবের কলকাতা । বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়
৫. কলিকাতা সেকালের ও একালের । হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
৬. রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য । প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৭. সংবাদপত্রে সেকালের কথা । ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
৮. সেকালের কলকাতা ও গ্রাম বাংলা । আশিস্ সরকার

No comments

Powered by Blogger.