মায়ের মুর্তি
মায়ের মুর্তি
সুস্মিতা ঘোষ
কথক - জগদীশ হলো এই কুমিরন গ্রামের নাম করা প্রতিমা শিল্পী । তার সংসারে মানুষ বলতে আছে সে আর তার বউ কমলা। এক সময় জগদীশের এই কুমারটুলির নাম আশপাশের আরও পাঁচটা গ্রামে বিখ্যাত ছিল । কিন্তু তা সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে গেছে। বয়স বেড়েছে । হাত পা তেমন তাড়াহুড়ো করে চলে না,তাই সেই কারনে এখন আর তাদের কাছে তেমন ঠাকুর বায়না ও আসেনা। এখন শুধু স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে ছোট ছোট মুর্তি তৈরি করে তাদের সংসার চালায়।
দৃশ্য – ১
(বিকেল বেলা । কুমর টুলি তে জগদীশ আর তার বউ কমলা রয়েছে । )
জগদীশ – কমলা, বালতিটা একটু এগিয়ে দাও তো, মাটি টা মাখি !
কমলা – এখন মাটি মাখবে ! নতুন কোনো ঠাকুরের বায়না এসেছে ?
জগদীশ – না বায়না আসেনি কোনো ! তবে বসে থাকতে ভালো লাগেছে না যে। শরীর খানিক অচল হয়েছে কিন্তু মন যে আগের মতোনই আছে।
কমলা- সে যা বলেছো , তবে দাও, কিছুটা মাটি আমাকেও দাও। আমি মেখে দিই।
( এরপর তারা খুশি মুর্তি তৈরির মাটি মাখতে থাকে )
কাট
দৃশ্য – ২
সন্ধ্যা বেলা । সমরেশ তাদের বাড়িতে আসে ।
সমরেশ – জগদীশ বাড়িতে আছো নাকি !
জগদীশ – সমরেশ বাবু। আসুন। এখন আমার বাড়িতে আপনি ! বলুন বাবু !
সমরেশ – আমার বাড়িতে মা লক্ষীর পূজো হবে । তাই তোমার কাছে বায়না দিতে এসেছি। মায়ের মুখ খানি যেন অপরূপ সুন্দর হয় ! মায়ের যেমন মায়া তেমন ই যেন হয় মুখখানা। আমি জানি তোমার সে হাত আছে, তুমিই পারবে। তাই তো তোমার কাছেই এলাম। তৈরি করে দেবে তো আমার মায়ের মুর্তি !
জগদীশ – হ্যা বাবু। নিশ্চয়ই তৈরি করে দেবো।
সমরেশ- ঠিক আছে তবে। ( কিছু টাকা দেয়) এই নাও ঠাকুর বায়না হিসাবে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে গেলাম । আমি সপ্তাহ খানেক পর এসে একবার দেখে যাবো।
সমরেশ – ঠিক আছে বাবু। তাই করো।
( সমরেশ চলে যাওয়ার পর । কমলা ঘরে এসে জগদীশ কে বলে )
কমলা – শেষ মেশ মায়ের বায়না এলো তবে ! তুমি মন খারাপ করছিলে না কদিন ! দেখো মা চলে এসেছে আমাদের কাছে ।
জগদীশ – হম গো তুমি ঠিক বলেছো। কাল সকাল থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করে দেবো ! সমরেশ বাবু আসবেন আগামী সপ্তাহে প্রতিমা দেখতে।
কমলা – হম, তাই কোরো, কাল থেকেই কাজ শুরু করে দেবো আমরা।
( এরপর তারা রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে তারা দুজন মিলে মাটি মেখে ঠাকুর তৈরী করে। )
দৃশ্য -৪
এক সপ্তাহ পর – ( সকালে)
জগদীশ – অনেক দিন পর মায়ের মুর্তি বানালাম বলো দেখি। এবার মায়ের চোখ আঁকলেই সমপূর্ণ হবে।
(কমলা প্রতিমার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে বলে )
কমলা – হম গো, মায়ের মুখের দিকে দেখো ! কেমন যেন লাগছে না মুখখানা। গতকাল তো এমন ছিল না ! মুখ টা দেখে কেমন যেন মনে হচ্ছে মা কাঁদছে !
(জগদীশ মুর্তির দিকে তাকিয়ে বলে)
জগদীশ – তুমি ঠিকই বলেছো। মুর্তি তো এমন ছিল না। এটা কিভাবে হলো ! দেখে সত্যি ই মনে তো হচ্ছে মা কাঁদছে। না না এ মুর্তি আমি কিভাবে দেবো সমরেশ বাবুকে ! মুখখানা ঠিক করতে হবে গো, ঠিক করতে হবে।
( জগদীশ মায়ের মুখ ঠিক করে)
জগদীশ – এবার ঠিক আছে গো ? দেখো !
কমলা – হম, এবার ঠিক আছে।
জগদীশ – চলো তাহলে এখন ঘরে যাই অনেক রাত হয়েছে। কাল সকালে উঠে বাকি কাজ করবো !
দৃশ্য -৫
( ঘুমের মধ্যে জগদীশ স্বপ্নে দেখে , মা লক্ষী বলছেন )
মা লক্ষী – আমি সমরেশের বাড়ি যাবো না জগদীশ। ও মেয়েদের সম্মান করে না, অবহেলা করে। ওর বাড়ি আমি যাবো না। ওখানে থাকতে আমার কষ্ট হয়।
(জগদীশের ঘুম ভেঙে যায়। সে চমকে ওঠে)
জগদীশ – একি ! এ আমি কি দেখলাম। এমন স্বপ্ন আমি কেন দেখলাম ! তাই কি মায়ের মূর্তি এতো দুঃখী মনে হচ্ছে !
কাট
দৃশ্য-৬
( জগদীশ আর কমলা তাদের কুমার টুলিতে গিয়ে দেখে মায়ের মুখ খানা বড্ড ভার হয়ে আছে)
জগদীশ – দেখো কমলা দেখো। মায়ের মুখ টা আবার কেমন ভার হয়ে আছে। তোমাকে তো সবই বললাম আমার স্বপ্নের কথা। তবে মা কি আমাকে কিছু বোঝাতে চাইলেন এ স্বপ্ন দিয়ে !
কমলা – আমি একবার জগদীশ বাবুর বাড়ি গিয়ে দেখি। ওনাকে বলে আসি যে আজ ওনার ঠাকুর দেখতে আসার কথা আছে,আর এই সুযোগে আমি দেখে আসবো যে উনি সত্যিই ওনার বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করেন নাকি! সকালে দেখা তোমার স্বপ্নের সত্যিই কোনো মানে আছে কি না!
দৃশ্য – ৭
( কমলা চলে যায় সমরেশের বাড়ি, বাড়ির ভিতর ঢোকার আগে সে দূর থেকে দেখে সমরেশ তার বউ কে বলছে -)
সমরেশ- ছি ছি ছি ! আবার বেড়নোর মুখে তুমি এসেছো ? তোমাকে না মানা করেছি আমি কোথাও গেলে তুমি সামনে আসবে না !
মালতি – কাঁদতে কাঁদতে ! আমি এমনি আসিনি , তোমার রুমাল টা কেচে দিয়েছিলাম দিতে এসেছি।
সমরেশ – তোমাকে তো আমি কিছু চাইনি। একটাই আবাদৰ করেছি , যে আমাদের একটা ছেলে হোক। একটা একটা করে তিনটে মেয়ে হলো , একটাও ছেলে হলো না। তাই তোমাকে আমার আর সহ্যই হয় না।
( কমলা কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। তারপর সেখানে আসে তার ছোট মেয়ে শালুক। )
শালুক – বাবা, বাবা দেখো তো আমি একটা ফুল এঁকেছি। এটা কেমন হয়েছে, দেখে বলো একটু।
সমরেশ – ( রেগে ) এসব ফুল এঁকে কোনো লাভ নেই বুঝলি। মায়ের সাথে রান্না ঘরে গিয়ে রান্না সেখ। মেয়ে মানুষ এর চেয়ে বেশি আর কিইবা করবি ! বই খাতা যা আছে সব উনানে দিয়ে দে।
( মেয়ে দুঃখী মনে চলে যায় )
সমরেশ – ( দুঃখ করে মনে মনে বলে। ) এই তিন তিনটে মেয়ে না দিয়ে যদি একটা ছেলে হতো আমার। সব ই কপাল ।
( শালুক কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে যায় । কমলা দূর থেকে এসব দেখে)
কমলা – ছি ছি। সমরেশ বাবু এই রকম ! মেয়ে কে মানুষই মনে করে না। তার বাড়ির বউ আর মেয়ের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন। এ বাড়িতে ঢুকতে যে আমার ই ইচ্ছে করছে না। মা কিভাবে আসবেন এখানে ! আমি বরং সমরেশ বাবুর বাড়ি না গিয়ে ফিরে চলে যাই।
কাট
দৃশ্য - ৮/ সন্ধ্যা বেলা
(সমরেশ জগদীশের কুমারটুলিতে আসে)
সমরেশ – একি জগদীশ ! মায়ের মুর্তির এখোনো তুমি রং এখনো সম্পূর্ণ করোনি ! আর দুদিন বাদেই মায়ের পুজো। আমি বলেছিলাম তো আজ মুর্তি দেখতে আসবো !
জগদীশ – হচ্ছে না সমরেশ বাবু ।মায়ের মুর্তি তে রং ধরছে না।
সমরেশ – মানে ! ইয়ারকি মারছিস নাকি তুমি ! রং লাগছে না মায়ের মুর্তি তে ! একথার মানে কি !
জগদীশ – আপনিই দেখুন নিজের চোখে। আমি এই শ্যামা রং করছি, দেখুন এটা কেমন ফিকে মাটি র রং হয়ে যাচ্ছে।
( জগদীশ রং করে কিন্তু শ্যামা কালার টা আবার ফিকে হয়ে যায়, সমরেশ অবাক হয়ে যায়, তিন থেকে চার বার একই ঘটনা ঘটে )
সমরেশ – এটা কিভাবে সম্ভব !
(কমলা আসে)
কমলা – আপনার মতো লোকের বাড়ি মা যেতে চান না।
( সমরেশ রেগে গিয়ে)
সমরেশ - ছোট মুখে এত বড়ো কথা বলার সাহস হয় কি করে তোমার ! কি বলতে চাইছো তুমি !
কমলা – এটাই বলতে চাইছি যে, যে বাড়িতে মেয়েদের সম্মান নেই। মেয়েদের কে মানুষ ভাবা হয় না সেই বাড়িতে মা যাবেন না। আপনি নিজের মেয়ে বউকে অবহেলা করেন । আর মা লক্ষী যে নিজেই স্বয়ং মেয়ে। এই অবহেলা তিনি মেনে নিতে পারবেন না।
জগদীশ – আপনি তো নিজের চোখেই সে প্রনাম পেলেন সমরেশ বাবু।
সমরেশ – তোমাদের বয়স হয়েছে জগদীশ। তাই তোমরা কাজ ভুলে গেছ ? মা যদি আমার উপর রুষ্ট হবে , তাহলে আমার অভাব হবে তোমাদের কেন অভাব ?
জগদীশ – দেখুন সমরেশ বাবু , কমলার বলা কথা গুলো কমলার না , মা লক্ষী আমার স্বপ্নে এসে বলেছেন । তাই আমি আপনার জন্য ঠাকুর করতে পারবো না। এই নিন আপনার অগ্রিম দেওয়া টাকা।
( সমরেশ টাকা টা নিয়ে রেগে বলে )
সমরেশ – ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হবে না জগদীশ। তোমার হাতের কাজ ভালো বলে এসেছিলাম , তাই বলে যা ইচ্ছা গল্প কথা বলবি আমি মেনে নিতে পারবো না।
( এই বলে সমরেশের বাবু বেরিয়ে যায়। )
কাট
দৃশ্য - ৮
সন্ধ্যা বেলা । সমরেশের বাড়ি । বাড়ির ফোন বাজছে
সমরেশ – হ্যালো ! ( ফোনটা তার হাত থেকে পরে যায় আর সে কেঁদে উঠে বলে)
সব শেষ হয়ে গেল। আমি বরবাদ হয়ে গেলাম। ( একটু বেশি করে কেঁদে দেবে )
পদ্ম – কি হয়েছে ? তুমি এমন করছো কেন ?
সমরেশ – আমার লক্ষ লক্ষ টাকার মাল নিয়ে জাহাজ ডুবে গেছে মালতি । আমি ব্যাবসার সমস্ত পুঁজি এতে দিয়ে দিয়েছিলাম । সব শেষ হয়ে গেল আমার।
পদ্ম – তুমি ওতো ভেঙে পড়ছো কেন ? কিছু হবে না ! মা চাইলে আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
সমরেশ – ( কাঁদতে কাঁদতে ) তুমি ঠিক বলেছো , মা চাইলে সব করতে পারে। আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়েছি।
পদ্ম – তুমি শান্ত হও ! কদিন বাদে মা লক্ষী বাড়ি আসবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
(সমরেশ বউ এর হাত ধরে কেঁদে বলে)
সমরেশ – আমায় ক্ষমা করো পদ্ম। ক্ষমা করো ! কোনো কারণ ছাড়া তোমাকে অনেক অপমান করেছি , সন্তান মেয়ে বা ছেলে দুটোই সমান, তার একটাই পরিচয় সে আমাদের সন্তান। আমি সেইটাই ভুলে গেছি , তাই মা রুষ্ট হয়ে আমাকে এই শাস্তি দিয়েছেন। তুমি মেয়েদের কে ডাক ! সবাই এক সাথে এখুনি জগদীশের বাড়ি যাবো , আমি আজিই মা কে বাড়ি আনবো।
( সমরেশ তার তিন মেয়ে বৌ কে নিয়ে জগদীশের বাড়ি যায়। )
( তখন কমলা বলে ওঠে)
কমলা – ওই দেখো তোমরা । মায়ের মুর্তি হাসছে। আর যেটুকু রং করা হয়েছিল। সেই টুকু রং ও লেগে আছে ।
জগদীশ – মা, তাহলে আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন সমরেশ বাবু।
পদ্ম – দাদা আপনি রং করে দিন। আমরা মাকে নিয়ে বাড়ি যাবো।
সমরেশ – ( হাত জোর করে ) জগদীশ আমায় ক্ষমা করে দাও ! আমি টাকার অহংকারে আমার ভুল গুলো আমি ভুল ভাবি নি। তাই মা আমায় শাস্তি দিয়েছেন। আর বৌদি তুমিও আমায় ক্ষমা করে দাও !
কমলা - যেখানে মা তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছেন , সেখানে আমরা নিমিত্য মাত্র।
গল্পটির অ্যানিমেশন ভিডিও -
No comments