মুক্তি
মুক্তি
স্নেহা পাত্র
দৃশ্য -১
সাল ১৯১২ | দুপুর বেলা | কলকাতার এক আপিসের কেরানিক সমরেশ বাবু যেন কি এক ভবানায় আচ্ছন্ন। হঠাৎই ম্যানেজার এসে বললেন ।
ম্যানেজার - কি হে সমরেশ কি এতো ভাবছো?
সমরেশ - ( বেশ ইতস্তত ভাবে ) না সাহেব, আমি ই……." (বলেই আমতা আমতা করে।)
ম্যানেজার - তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি কিছু মনে করো না হে….
সমরেশ- না না, কি বলবেন বলুন ।
সব্যসাচী- না আসলে কাজের কথা তো নয়। (বেশ চিন্তিত ভাবেই বলেন)
সমরেশ - তাহলে?
ম্যানেজার - আচ্ছা তোমার একটি মেয়ে আছে না?
সমরেশ - হ্যাঁ ! কিন্তু কেন বলুন তো ! (বিস্ময় গলা স্পষ্ট)
ম্যানেজার - তা বয়স কত হলো?
সমরেশ - তা হল এগারো বৎসর।
ম্যানেজার - (অত্যন্ত আনন্দের সহিত বললেন) বাহ ! তা মেয়ের বিয়ের কথা কিছু ভেবেছ?
কথক - বিয়ের কথা শুনেই মুখটা শুকিয়ে গেল সমরেশ বাবুর। সেই সব না দেখেই ম্যানেজার মশাই বলে চললেন -
ম্যানেজার - আরে উত্তর কলকাতার রায় বাড়ির ছোট ছেলে দেবজ্যতি রায়, এই বিলেত থেকে ফিরেছে। পেশায় ব্যারিস্টার। তার অপর আবার রায় বাড়ির নিজস্ব ব্যবসাও আছে, সেটিও নেহাত মন্দ না। মোট কথা পরিবার আর পাত্র উভয়ই বেশ ভালো।
( সমরেশ কিছু বলে না চুপ করেই থাকে। শুধু মুখে ভেসে ওঠে চিন্তার ছায়া। ভ্রু কুঁচকে যায়…….)
সব্যসাচী - কি হে সমরেশ কিছুই তো বলছো না, ওদের বাড়ির বেপারেও তো তোমায় একটু বলি। আসলে মাঠাকুরনের অনুরোধেই আমার পাত্রী খোজা।ছেলেকে এবার সংসারের জলে বাধঁতে চান আর কি ! (বলেই হেসে ওঠেন)
সমরেশ - আচ্ছা ! শুনলাম তো সবই। দেখি বাড়ি গিয়ে……( কথা শেষ হয় না)
সব্যাসাচী- হ্যা। তুমি বাড়ি গিয়ে আগে বৌঠান কে
শুধাও। কি বলে দেখো। (হেসে চলে যান)
কথক - অফিস শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নানান কথাই মাথায় আসে সমরেশের। সত্যিই তো মেয়ের বিয়ের বয়স হলো বটে।
কাট
দৃশ্য-২
কথক - বাড়ি ফিরেই সমরেশ বাবু তার স্ত্রী মালতিকে সব কথা খুলে জানায়, মালতিদেবী যেন এক কথায় রাজি।
মালতি - বলো কি গো ! রায় বাড়ি ! সে তো অনেক বড়ো বাড়ি ! বনেদি বংশ গো। তুমি আজই হ্যা করে দাও। বাবাগো ! তুমি ভাবতে পারছ ! আমাদের মেয়ে রাজরানী হবে গো রাজরানী !
কথক - মিনতি, অতিসুন্দরী, গায়ের রং খানাও বেশ। নাক মুখ বেশ টিকালো। এতদিন তার মা বাবা তাকে বেশ যত্নেই রেখেছে । মাসখানেকের মধ্যেই রায় বাড়িতে বিয়ে লাগল। জলসা বসলো,বিদেশ থেকে সাহেব লোকরা এলো, খানাপিনার আয়োজনে সমস্ত উত্তর কলকাতা মেতে উঠলো। সাত পাকে বাঁধা পড়লো চব্বিশ বৎসরের দেবজ্যোতি রায় আর এগারো বছরের মিনতির সাথে।
দৃশ্য -৩
সকালবেলা । অন্দরমহলে মিনতি ও তার বড়োযা রান্না করছে।
বড়দি - তুই ওতো মনমরা হয়ে আছিস কেন ?
মিনতি - কিছু না তো।
বড়দি - তুই খুব ভাগ্যবান। জানিস, তর ভাসুরের তো আর একখান বিয়ে হয়ে ছিলো, সে এখানে বেশিদিন থাকতে পারেনি । এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে তখন আমায় বিয়ে করে আনলো। আমি তখন ধর তর বয়সী। ভয়ের কিছু কারণ নেই। দুদিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
মিনতি - আচ্ছা ! দিদিভাই যদি তোমার ভাইটিও যদি এমনি কাউকে বিয়ে করে ঘরে আনে তখন আমার কি হবে গো?
বড়দি - ওসব কথা বলিস নি মুখপুড়ি। যেচে ঘরে সতীন আনবি নাকি ? ছোটঠাউরপো বড়ো ভালো রে, ওসব কথা মাথা তেও আনে নে।
কাট
দৃশ্য - ৪
রাতের বেলা। দেবজ্যতি খাটে কিছু বই নিয়ে বসে আছে। মিনতি গ্লাসে করে দুধ নিয়ে আসে। দেবজ্যতি দুধ খেয়ে বলে।
দেবজ্যতি - এগুলো কি বই বলতো ?
মিনতি - এতো মোটা মোটা ইংরাজি বই ?
দেবজ্যতি - ইটা ইংরেজিতে লেখা বই বটে ! তবে এটা ইংরেজি বই না , এটা আইনের বই। তুমি ইংরাজি পড়তে পারো ?
মিনতি - না , তবে বাংলা পড়তে পারি।
দেবজ্যতি - ঠিক আছে তোমায় আমি শিখিয়ে দেবো। তোমার বয়স তো কম। তাই এখন থেকে অল্প অল্প করে পড়লে তুমিও একদিন অনেক কিছু শিখে যাবে।
মিনতি - আমি পড়বো ? এই বই গুলো আমি পড়বো? আমার খুবই ইচ্ছা, আমিও মোটা মোটা বই পড়ব। আমার মোটা বই পড়া বলতে রামায়ণ আর মহাভারত।
দেবজ্যতি - দেখবে তুমিও একদিন এই মোটা মোটা সব বইগুলো পড়তে পারবে ।
কাট
দৃশ্য -৫
কিছুদিন পর সবাই এক সাথে রাত্রে খাবার সময়
দেবজ্যতি - মা তোমায় একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হয়নি।
মা - বল না বাবা।
দেবজ্যোতি - মা দেখ আমার এই বিসনেস এর কাজ খুব একটা ভালো লাগছে না, আমি আরো পড়াশোনা করতে চাই। এসে আমি ওকালতি করবো।
বড় কর্তা - তুই ওকালতি কর তোকে কে বারণ করেছে ?
দেবজ্যতি - দেখ দাদা, আসল কথাটা হলো আমি আবার বিলেতে যেতে চাই, সেখানে গিয়ে আরো ডিগ্রী নিতে চাই।
মা - মানেটা কি ? তোর সবে কদিন হলো বিয়ে হয়েছে। তুই এখন বাইরে চলে যাবি ?
দেবোজ্যোতি - দেখো মা তোমরা বিয়ে করতে বলেছো ,আমি বিয়ে করেছি , আমি পড়াটা কমপ্লিট করেই চলে আসবো। আমাকে বাধা দিও না।
মা - না না বাবা আর বিলেত গিয়ে কাজ নেই, এই তো কদিন আগেই এলি। তুই গেলে ছোট বৌমা কে কে দেখবে ? এই সংসারেরই বা কি হবে রে।
দেবোজ্যোতি - এখানের সব দেখা সোনার জন্য দাদা তো আছেই, আর বৌদি তো আছে মিনতি কে দেখে রাখার জন্য, আর এই সংসারের কথা বলছো সে তো তুমি ছাড়া কেউ দেখে রাখতে পারবে না মা। আর কি বলতো আমার এইটুকু ডিগ্রী তে কিছুই হবে না মা। আরো পড়তে হবে, নাহলে ইংরেজ দের সাথে পাল্লা দেব কিভাবে?
কথক - এই ভাবে বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে দেবোজ্যোতি তার মা ও দাদা কে রাজি করিয়ে নেয়। মিনতি ও তার বড়োযা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবই শুনলো কিছু বলতে পারলো না। শুধু মিনতি কে একবার বললো
বড়দি - সেই কপাল টা পোড়ালি তো। বরটাকে একটু বেঁধে রাখতে পারলি না?
( এই বলে চলে যায়। কোনো কথা না বলে মিনতিও ঘরে চলে যায়।)
কাট
দৃশ্য -৬
মিনতি ঘরে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। দেবজ্যোতি ঘরে আসতেই সে রেগে অভিমানে বলে ওঠে।
মিনতি - আমি তোমার কি করেছি ? যে আমায় ছেড়ে তুমি চলে যাবে ?
দেবজ্যোতি - আমি কি বলেছি তোমার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি তো যাচ্ছি পড়াশোনা করতে, আবার শেষ হলেই ফিরে পড়বো আর ফেরার সময় তোমার জন্য ওখান থেকে বিদেশি পোশাক আর বেশ কিছু ইংরেজি বই আনবো। ততদিনে তুমি তোমার এই বইগুলো শেষ করে ফেলো, আমি এসে তোমার পরীক্ষা নেবো কিন্তু। ( বলে খানিকটা হেসে নেন।)
( মিনতি মুখভার করেই দাঁড়িয়ে থাকে)
দেবজ্যতি - রাগ করো না , এর পরের বার তোমাকেও নিয়ে যাবো। তারই খানিক বন্দোবস্ত ও করে আসতে হবে তো নাকি?
মিনতি - আমাকেও নিয়ে যাবে? (বিস্মিত চোখে)
দেবজ্যতি - হ্যা তোমাকেও নিয়ে যাবো। তখন তুমি এই বন্ধ অন্দরমহল জীবন থেকে মুক্তি পাবে। তুমিও সমস্ত পৃথিবীকে উপভগ করবে।
( এই কথা শুনে মিনতি স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায়। )
কথক - প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেছে। ইতিমধ্যে বৌঠান অসুস্থ হয়ে মারা গেছে । বাড়ির সবথেকে কাছের মানুষ টাকে হারিয়েছে মিনতি। হেঁসেল থেকে উঠান সব দায়িত্ব এসে পড়েছে ১৬ বছরের মিনতির ওপর। কে জানে নিয়তি, মিনতির জন্য আরোও কিছু খারাপ লিখে রেখেছেন ! একদিন রাতে হটাৎই স্ত্রী হারা মিনতির বড়ো ভাশুর মদ্যপ অবস্থায় মিনতির সাথে অশ্লীল আচরণ শুরু করে।( হাত ধরে টানে )
মিনতি- একি কি করেছেন দাদা ? ছি ! ছাড়ুন আমায়। আপনার লজ্জা করে না। ছাড়ুন বলছি। এক্ষুনি কিন্তু আমি মা কে ডাকবো।
বড় কর্তা - মা !! হা! হা! (হেসে ওঠেন) তোমার মনে হলো, মা নিজের ছেলে কে ছেড়ে দিয়ে তোমার কথায় বিশ্বাস করবে? (আবার ও হেসে ওঠেন)
মিনতি - ছেড়ে দিন বলছি ভালো হবে ন কিন্তু, আমি কিন্তু চিৎকার করবো।
বড় কর্তা - করো ! যত খুশি চিৎকার করো
মা - ( দৌড়ে আসে ) কি হয়েছে বৌমা ? ( মিনতি দৌড়ে মায়ের কাছে চলে যায়। তার শাশুড়ি মায়ের বুঝতে আর অসুবিধা হয় না। ) ছিঃ খোকা ছিঃ ! আমার ওই লক্ষী প্রতিমার মতো বৌমা কে তো বাঁচাতে পারলি না। তোর এই মদ খাওয়ার জন্যই যত অশান্তি। তাই তাকে অকালে চলে যেতে হলো। শেষে নিজের ভাইয়ের বৌয়ের হাত ধরে টানা টানি করছিস ?
বড় কর্তা - মা তুমি ভুল ভাবছো। ও ভুল বলছে। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।
মা - থাকে ,কে ভুল বলছে , সে তোর মুখের গন্ধ থেকেই জানা যাচ্ছে। তুই এখুনি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। আমি বেঁচে থাকতে তুই এই বাড়িতে আসবি না। আমার নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে যে আমি তোর মতো ছেলেকে জন্ম দিয়েছি।
( বড় কর্তা চলে যায় )
দৃশ্য - ৮ (অন্তিম পর্ব)
কথক - মিনতি এখন আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর। বাড়ির বাইরের অনেকেরই কু নজর পরে তার উপর। তাই তার শাশুড়ি কঠোর ভাবে নির্দেশ দেয়, ছোট ছেলে বাড়ি ফেরার আগে পর্যন্ত সে যেন কোনোদিন বাইরে না যায়। শাশুড়িরই এই নির্দেশে মিনতির নিজের ঘরেই বন্দি দশা হলো। সে জানালার ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে তার স্বামীর প্রত্যাবর্তন কল্পনা করে, আর ভাবে কবে তার স্বামী এসে তার পরীক্ষা নেবে। তাকে যে বন্দি দশা থেকে মুক্তি দেবে।
( একদিন ঝিয়ের মুখে মিনতি খবর পায়। )
ঝি - জানো ছোট গিন্নিমা, এতদিন বাদে ছোট কত্তা গিন্নি মা কে চিঠি লিখেছে।
মিনতি - লিখেছে ! কি লিখেছে রে? আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে? তুই কি মায়ের কাছ থেকে চিঠি টা এনে দিতে পারবি ?
( ঝি চুপ করে থাকে, কিছু বলে না।)
মিনতি - চুপ করে গেলি কেনো কি লিখেছে বলবি তো নাকি?
ঝি- লিখেছে……মানে লিখেছে…
মিনতি- হ্যাঁ ! কি লিখেছে বল । এতো আমতা আমতা করছিস কেন? অন্য সময় তো মুখে খই ফোটে তোর। আজ কি হলো আবার?
ঝি - আসলে কি বলতো…ছোট বাবু আর ফিরবে না।
মিনতি- ফিরবে না ! মানে? কি বলছিস তুই। ফিরবে না মানে ! কেনো কি হয়েছে তার? ফিরবে না কেন? চুপ করে থাকিস নে লক্ষীটি বল আমায় কি হয়েছে তার?
ঝি - তোমার কপাল টা সত্যি ই পোড়া গো ছোটগিন্নিমা।
মিনতি - কি!
ঝি- ছোটকত্তা বাবু বিলেতে এক মেমসাহেব কে বিয়ে করেছে। তাই সে আর দেশে ফিরবে না । ওখানেই থাকবে। আর এই সব শুনে গিন্নিমাও শজ্যা নিয়েছে গো।। (বলেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে ঝি)
কথক - এই কথা শোনার পর মিনতি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মর্যাদাহিনতা, সম্মানহানি সব যেন তাকে গ্রাস করে। মিনতির দুচোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। আসতে আসতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। গিন্নিমার ঘরে গিয়ে দেখে যে মানুষর এক ডাকে গোটা রায় বাড়ি তথষ্ঠ থাকতো সে কিনা এভাবে শয্যাসায়ী। গিন্নিমার পায়ের কাছে গিয়ে বসল। আর তার পা দুখানি স্পর্শ করে প্রণাম করল। চোখের সামনে তার শৈশব, বিবাহ, খোলা আকাশ, পাখিদের উড়ে যাওয়া আর দেবজ্যতির মুখে শোনা স্বপ্নের মতো সুন্দর নিজের মনে গাঁথা বিদেশের কল্পনার জগৎ গুলো এক ঝলকে ভেসে ওঠে। এরপর ধীরে ধীরে মিনতি মাটিতে লুটিয়ে পরে।
গল্পটির অ্যানিমেশন ভিডিও -
No comments