তালতলার জঙ্গলে

তালতলার জঙ্গলে

সৌরভ দত্ত

bhuter story
তালতলার জঙ্গলে


Scene 1

অন্ধকার ঘন জঙ্গল।  তেতুল গাছের ডালে এক পেত্নী পা ঝুলিয়ে বসে আছে। 

পেত্নী: খিদে ! খিদে! খিদে! অসহ্য খিদে ! … রোজ রোজ সাপ ব্যাঙ খেয়ে খেয়ে জিভে চড়া পরে গেছে। দুদিন ধরে তো জঙ্গলে কোনো সাপ, ব্যাঙও পাচ্ছিনা।


( তখন বাতাসে গন্ধ ভেসে আসে , পেত্নী নাক টেনে শুকে গন্ধ নেয়। সেই সময়  জঙ্গলে এক ব্যক্তি সাইকেল নিয়ে প্রবেশ করে। )

পেত্নী:  আহা ..কোথা থেকে আসছে এ সুভাষ ? আমি নিশ্চিত এ কোনো সাস্থবান মেদবহুল মানুষ। অনেকদিন পর মহাভোজ খাওয়া হবে। আমার তো ভেবেই জিভ দিয়ে জল গড়াচ্ছে । যাই কিছুক্ষণের জন্য গা ঢাকা দিই। ( পেত্নী গায়েব হয়ে যায়। )

ব্যাক্তি: সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। সন্ধ্যা পড়তে না পড়তেই এই জঙ্গল যেন রূপ পাল্টে ফেলে। ( বন্য পাখি ডেকে ওঠে। ওই ব্যাক্তি আতকে ওঠে। )

ব্যাক্তি: থু…থু…থু… তোদেরও কি আর কাম নেই, এই ভর সন্ধ্যায় আমারে ভয় দেখানো ছাড়া।

( ওই ব্যাক্তির পিছনে পেত্নী উদয় হয়।)

পেত্নী: পাখির ডাকেই এই ! তাহলে আমাকে দেখে কি করবি রে তুই।

ব্যাক্তি: কে … কে..???

( ওই ব্যক্তি পিছন ঘুরে তাকায়। পেত্নীর চোখ আগুনের মতো জ্বলছে। তা দেখে ওই ব্যাক্তি গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে ওঠে। পেত্নী হেসে ওঠে। পেত্নী দুই হাত বাড়িয়ে ওই ব্যক্তির দিকে এগিয়ে এসে তার গলা টিপে ধরে।


কাট 



৫ বছর পর


Scene 2 

মাটির বাড়ি। সকাল।

কাতু(৪৫) কয়েকজন বাচ্চাকে (তিন বালিকা ও দুই বালক) ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে পড়াচ্ছে। 

কাতু: রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,

বাচ্চারা ( একত্রে ):  রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,

কাতু : বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে।

বাচ্চারা: বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে।

কাতু: আজ তাহলে এটুকুই পড়া থাকলো। বাড়ি থেকে পড়ে আসবি । দুজন বালক পিসি আসছি বলে চলে যায়। কিন্তু চিনা, দুর্গা আর টুলু বসে থাকে।

কাতু: ও টুলু ও চিনা, দুর্গা, কিরে তোরা যাবিনা?

টুলু: পিসি তুমি নাকি ভবের হাটের চড়ক  মেলায় যাচ্ছ?

চিনা: আমাদের নিয়ে চলনা পিসি।

দূর্গা: চলনা…চলনা…

কাতু: মানিকরা ওখানে যেতে চাসনা। আমি নিয়ে যেতে পারবো না ! সামনে দীঘার পাড়ে তে রথের মেলা আছে সেখানে নিয়ে যাব।

টুলু: তুমি আমাদের আর আগের মতো ভালোবাসো না পিসি।

কাতু: এসব কি বলছিস তোরা। ওতো দূর তোদের বাড়ি থেকে ছাড়বে না যে। তাছাড়া…

টুলু : একবার বলেই দেখোনা…

দূর্গা: বলনা…

কাতু: আচ্ছা! আচ্ছা! চল।

কাতু হেঁটে চলে টুলু, চিনা আর দুর্গার বাড়ির উদ্দেশ্যে।




Scene 3

টুলুর মাটির বাড়ি। সকাল।
টুলুর মা সবজি কাটছে। 

কাতু: বৌদি রান্না করছো নাকি?

টুলুর মা: ও কাতু এসো। তা সব দল বেঁধে যে !

কাতু:  দেখোনা এরা সবাই ধরেছে ওদের চড়ক মেলায় নিয়ে যেতে হবে … আমিতো যাবো কাঠি ভাজা বেচতে।

টুলুর মা: চড়কের মেলা মানে তো সেই তালতলার জঙ্গল পার করে যেতে হবে । তুমি তো জানো সবই কাতু। না না টুলু ওখানে আমি যেতে দেব না।

টুলু: যাই না… যাই না মা।

টুলুর মা: বায়না করেনা।

কাতু : আমি নয় সন্ধ্যা নামার আগেই ওদের নিয়ে আসবো…

চিনা+দূর্গা: যেতে দাও না কাকি মা ….

টুলুর মা: যাও তাহলে নিয়ে। যা বললে মাথায় রেখো, সন্ধ্যার আগে নিয়ে আসবে।


( এর পর তারা কাতু একে একে বাকিদের বাড়ি যায়। )


কাট 


Scene 4

কাতুর বাড়ি। দিন। কাতু, টুলু, চিনা , দূর্গা সবাই তৈরী হয়ে কথা বলছে।


টুলু: তুমি মিছেই চিন্তা করছিলে। দেখলে তো আমাদের বাড়ির সবাই তোমার সাথে যেতে মানা করলো না। 

কাতু: নে চল চল সবাই, আবার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।  

( সবাই বেরিয়ে পরে )


কাট 


Scene 5 

রাস্তা। দিন। সবাই হেঁটে চলেছে। হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলে পৌঁছায়।


কাতু: দিনের বেলায়ই দেখছিস কেমন অন্ধকার হয়ে থাকে।

টুলু: এই কারণেই বুঝি মা আমাদের আসতে মানা করছিল।

কাতু (মনে মনে ) : তোদের যে কিভাবে বোঝাই , সন্ধ্যা নামলে এখানে তেনাদের উৎসব শুরু হয়।

( এই কথা বলতে বলতে তারা জঙ্গল পেরিয়ে মেলায় পৌঁছায় )


কাট 




Scene 6
মেলার মাঠ। বিকেল। চড়ক মেলার মাঠে মানুষের ভিড়। 


কাতু: দেখ আসতেই বিকেল হয়ে গেলো। এখনোতো চরকের ঘূর্ণি শুরু হয়নি । কাঠি ভাজা কটা বিক্রি করে নিই। কাঠি ভাজা , কাঠি ভাজা…কয়েকজন বাচ্চা এসে কাঠিভাজা কেনে। 


( কাতুর প্রতিবেশী নগেন কাতুকে দেখতে পায়।)


নগেন: কাতু দি এখানে? ও বাচ্চারাও আছে দেখছি….

কাতু: নগেন... তুমি এখানে?

নগেন : একটু কাজে এসেছিলাম… তাই ভাবলাম ফেরার পথে মেলা হয়ে যাই। আমি আসছি। তোমরাও বেলা থাকতে বেরিয়ে পোরো …. 

কাতু: হ্যাঁ।

(নগেন চলে যায়।)

কাতু: যাক ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। সবকটা কাঠিভাজা আজ বিক্রি হয়ে গেলো। চল চল ওদিকে চরকের ঘূর্ণি শুরু হবে।

( চরকের ঘোড়া দেখে টুলুর মাথা ঘোরাতে থাকে। )

টুলু: পিসি মাথা ঘুরচ্ছে…( এই বলে টুলু অজ্ঞান হয়ে যায়। )

কাতু: কি হলো টুলু ? কেউ একটু জল দাও।

( একজন জল এনে দিলো। কাতু জলের ছিটা দিতে থাকে। টুলু চোখ মেলে। )

কাতু: এখন ভালো লাগছে?

টুলু: হ্যাঁ পিসি।

কাতু: হাঁটতে পারবি তো? 

টুলু: হ্যাঁ। 

কাতু: বাড়ি ফিরতে হবে মানিকরা । বেলা গড়িয়ে গেছে। এখন আর থাকা যাবে না....

( এই বলে সবাই মেলা থেকে বেরিয়ে পরে হাঁটতে থাকে। )


কাট 


Scene 7 

জঙ্গল। সবাই জঙ্গলের মধ্যে হাঁটছে। জঙ্গল অন্ধকার লাগছে।

কাতু: জঙ্গল পুরো অন্ধকার হয়ে গেছে। তারমধ্যে টর্চও জ্বলছে না। 
তারা হঠাৎ খেয়াল করে জঙ্গলের মধ্যে এক ঝাক জোনাকি নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে চলেছে। 

চীনা: জোনাকিরা এভাবে কোথায় যাচ্ছে ! 

কাতু: সবাই চুপ করে চল , একদম কথা বলিস না।

দূর্গা: ও মা গো ! পিসি, ভূত !

( বাকিরা তাকায়। দেখে কিছুটা দূরে একটা গাছে পেত্নী পা ঝুলিয়ে আছে। আর তাকে ঘিরে জোনাকিরা। ) 

পেত্নী: কার গলা পেলাম মনে হলো। আহা কতদিন পর মানুষের গন্ধ ! 

চিনা: পিসি ভয় করছে....

টুলু: আমি মায়ের কাছে যাবো…

দূর্গা: পিসি এবারে কি পেত্নী আমাদের ঘাড় মোটকে দেবে ?

( রাস্তা থেকে একটা ঝোঁপে লুকিয়ে 

কাতু:  আমার কথা মন দিয়ে শোন। এখন কান্নাকাটির সময় না। আমাদের বুদ্ধি করে জঙ্গল থেকে বেরোতে হবে।

( পেত্নী কিছুটা কাছের একটা গাছের কাছে এসে এদিক-ওদিক দেখতে থাকে। )

পেত্নী: কই গেলি? কই গেলি রে….আমার সময় যত নষ্ট করবি তত কষ্ট দিয়ে মারবো… তাই বলছি বেরিয়ে আয়… বেরিয়ে আয়।  বুঝতেও পারবি না কখন যে তোদের প্রাণ বায়ু বেরিয়ে গেল।

কাতু: সোনা-মানিকরা কোন শব্দ করবি না, মাথা নিচু করে ঝুঁকে পা টিপে টিপে চল। যাই হয়ে যাক না কেন মুখ থেকে একটু শব্দটিও যেন না বের হয়। কাতু এবং বাকিরা মাথা ঝুকিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটতে হাঁটতে একটা প্রকাণ্ড আমগাছ এর কাছে এসে দাঁড়ায়।


কাতু ( মনে মনে ): হে ভগবান এবারে আমি কি করবো ?

নগেন: কাতু দি?

( কাতুর নাম ধরে ফিসফিসিয়ে গলায় ডাক শুনে কাতু কেঁপে ওঠে। )

নগেন: কাতু দি আমি নগেন। আমি এই গাছের কোটরে ঢুকে আছি। তোমরাও চলে আসো।

(সবাই গাছের কোটরে ঢুকে পড়ে।)

কাতু : তুমি যে অনেকটা আগেই বেরিয়েছিলে নগেন।

নগেন: বেরিয়েছিলাম কিন্তু জঙ্গলে পা রাখতেই দেখি তেতুল গাছের মগডালে ওই পেত্নী  বসে। এক বুনো পাখি ডানা ঝাপটিয়ে তার পাশ দিয়ে উড়ছিল, হঠাৎই সে তার লম্বা হাত দিয়ে পাখিটাকে ধরে ফেলে। আমি নিজের চোখে দেখলাম ওই পেত্নী জ্যান্ত পাখিটার ডানা টেনে টেনে ছিঁড়ল, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে গিলতে লাগলো। এ দৃশ্য দেখে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, গা-হাত-পা কাঁপতে থাকে। শেষে কি করব বুঝতে পারি না, তখন থেকেই এই গাছের কোটরে লুকিয়ে বসে আছি ।

কাতু: নগেন দা আমরা কি করবো এখন ?

( পেত্নী দেখি এদিকেই এগিয়ে আসছে।)

নগেন: বুঝে উঠতে পারছিনা কাতু দি।

( কথা বলতে বলতে নগেন মাটিতে হাতরায়। বুঝতে পারে কিছু পাথর হাতে স্পর্শ হলো।)

নগেন: কাতুদি, মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। দেখো, পায়ের কাছে অনেক ঢিলা পড়ে আছে।

 কাতু: ঢিলা দিয়ে কি হবে? 

নগেন: ওই পেত্নীর এদিক-ওদিক ঢিলা ছুরে ওর নজর এদিক থেকে সরাতে হবে। 
নগেন এবং কাতু ঢিলা হাতে নিয়ে পেত্নীর বিপরীতে ছুড়ে তা শুনে পেত্নী সেদিকে এগিয়ে যায়। 

প্রেতনী: এবারে হাতে পেয়েছি রে …

কাতু: নগেন দা এভাবে বসে থাকলে তো ও আমাদের কখনো না কখনো ধরেই ফেলবে।

নগেন: তাহলে ? 

কাতু: আমাদের আস্তে আস্তে এগোতে হবে…মানিকরা আস্তে আস্তে এগোও সামনের দিকে।

 ( পেত্নী জঙ্গলের মধ্যে ওদেরকে খুঁজেই চলেছে। )

পেত্নী: খিদে যে বেড়েই চলেছে…

( কাটা ঝোপের কাঁটায় চিনার পা কেটে যায়। )

চিনা: আ…..পিসি!

( পেত্নী পিছন ঘুরে তাকায়। )

কাতু: এ কি করলি তুই চিনা!

পেত্নী: আমার সঙ্গে এতক্ষণ ছলনা চলছিল ! আমার সাথে ! ছাড়বো না … একজন কেউ ছাড়বো না। আজ আমার মহাভোজ হবে। হাহাহাহা …(হাসি)

 নগেন: পালাও…

কাতু: মানিকরা পালা…. সোজা পালা দাঁড়াস না…

( সবাই দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে থাকে )

টুলু+ চীনা +দুর্গা: ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রাম লক্ষণ সাথে আছে, করবি আমার কি ?

নগেন: রাম রাম রাম রাম রাম 

কাতু: হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে , হরে রাম হরে রাম , রাম রাম হরে হরে। 

পেত্নী: কোথায় পালাচ্ছিস… তোদের নিস্তার নেই আমার হাত থেকে…

কাতু: থামিস না তোরা…

( সবাই মনের জোরে দৌড়াতে থাকে। পেছনে পেত্নী তাড়া করতে থাকে এবং একঝাক জোনাকি। দেখতে দেখতে তারা জঙ্গল পার হয়ে বেরিয়ে আসে। হাঁপাতে থাকে। )

টুলু: আর দৌড়াতে পারছিনা পিসি…

নগেন: মনে হয় আমরা তালতলার জঙ্গল পেরিয়ে এসেছি…

কাতু: তাই হবে…পেত্নীর আওয়াজ বা জোনাকির ঝাঁকও দেখছিনা…

( সামান্য দূরে কোথা থেকে কিছু বিক্ষিপ্ত আলো দেখতে পায় তারা। )

টুলু: ওগুলো কিসের আলো?

দূর্গা: পেত্নী কি আবার ফিরে এলো?

কাতু: ভয় পাসনা। ওগুলো মনে হচ্ছে টর্চের আলো।

( দূর থেকে কয়েকজনের ডাক শোনা গেলো। )

কয়েকজন: কাতু? টুলু? দূর্গা? চিনা? তোরা কোথায়?

টুলু: বাবার গলা… বাবা এসেছে…আমাকে নিতে।

কয়েকজন লোক ওদের দিকে এগিয়ে আসে টর্চ হাতে।

কাতু: আপনারা এসেছেন…

টুলুর বাবা: তোমরা যে ফিরছিলে না…. চিন্তায় যে আমাদের…

নগেন : কি হয়েছিল জানেন…

টুলুর বাবা: এখন থাক সেসব কথা। বাড়ি ফিরে সব শুনবো। এখানে বেশিক্ষণ আমাদের থাকা ঠিক হবেনা।

সবাই হেঁটে চলে।


👉এই গল্পের অ্যানিমেশন ভিডিও -








No comments

Powered by Blogger.