দোতলা বাড়ি ( শিবু - পচা)


ভাঙা দোতলা বাড়ি ( শিবু - পচা)

সুকান্ত দাস 

ভাঙা দোতলা বাড়ি




সিন্ ১

সন্ধ্যাবেলা । একটি গাছের তলায় শিবু আর পচা দুজনে দাঁড়িয়ে আছে !

শিবু : নয়ন দা বলেছিল এই গাছের তলাতেই আসতে, এখন তো অন্ধকার হয়ে গেছে , কিন্তু নয়ন কোথায় বলতো ?

পচা: আমি কি করে জানবো বলতো , তুই যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস , আমিও তো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। মাসির বাড়িতে আসার পর থেকেই নয়নদা কিন্তু আমাদের কাছে ঘুরঘুর করছিলো,  নিশ্চয়ই কোন একটা ব্যাপার আছে,  না হলে রাতের বেলা আমাদেরকে এখানে ডাকবে কেন ?

শিবু : চুপ কর চুপ কর !  ওই দেখ কে যেন আসছে।

পচা - আরে ও তো নয়ন দা ! ( ডাকে )  ও নয়নদা, এই তো আমরা এখানে…

কথক : ওরা‌ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সে জায়গাটায় আলো নেই, আসলে‌ গাছের তোলাটা অন্ধকার। ওদের ডাকার আওয়াজে নয়ন ওদের দেখতে পেলো।  তাই ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে গলাটা একটু নামিয়ে চুপি চুপি বললো। 

নয়ন :  চিৎকার করিস না,  কেউ যদি জানতে পারে আমরা এখানে এসেছি তাহলে বিপদ হবে। পচা তুই কি জানিস তোর মাসির বাড়ির পিছন দিকে একটি পুরোনো ভাঙ্গা বাড়ি আছে ?

পচা : ওই ভূতের বাড়িটা ? ওই বাড়িটার কথা আমি আবার জানবো না ! একবার রাতের বেলা ওখানে যা দেখেছিলাম …

নয়ন: কয়েকদিন আগে রাতের বেলা ওই ভাঙা বাড়ির কাছে একটা লোককে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে কিন্তু কিন্তু লোকটার শরীরে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। আমার মনে হয় মৃত্যু টা কোনো ভুতুড়ে ব্যাপার ! তোরা তো অনেক কিছু করিস। তোদের ব্যাপারে অনেক কিছুই শুনেছি, একবার ওই  বাড়িটার কাছে রাতের বেলা গিয়ে দেখ না তোরা । যদি কিছু করতে পারিস !

শিবু ; সে তো যেতেই পারি তবে আজ কিছুতেই যাওয়া যাবে না। বাড়ি থেকে কিছু বলে আসিনি, এক্ষুনি আসবো বলে বেরিয়েছি। কাল রাতের বেলায় বাড়িটার কাছে যাবো।

কথক ; ওই বাড়ি নিয়ে এটা ওটা কথা বলতে বলতে ওরা এগিয়ে গেল গ্রামের দিকে।  নয়ন বললো

নয়ন : কাল দিনের বেলা পারলে একবার বাড়িটা দেখে আসিস,  বুঝলি তো ? না হলে আবার রাতের বেলা গিয়ে কিছুই বুঝতে পারবি না তখন আবার বিপদে পড়বি ! আমি কিন্তু তোদের সঙ্গে যাবো না।

পচা : তুমি আমাদের ওখানে যাওয়ার কথা বলছো অথচ তুমি যাবে না ?

নয়ন : আমার তোদের মত ওতো সাহস নেই রে, আমার বোরো ভয় করে । কিন্তু ওইখানে কি আছে সেটা জানার বড় কৌতুহল আমার,  তাই তোদের বললাম !

কথক ; শিবু এবং পচা দুজনেই একটু মৃদু হাসলো তারপর তিনজনে মিলে গ্রামের দিকে ফিরে গেল। 

কাট 


সিন্ ২
রাতেরবেলা । ভুতুড়ে বাড়ি ! হ্যারিকেন নিয়ে শিবু ও পচা দাঁড়িয়ে !

শিবু : দিনের বেলা কিন্তু বাড়িটাকে দেখে এমন মনে হয়নি রাতের বেলা কেমন যেন মনে হচ্ছে না ? মনে হচ্ছে এই অল্প সময়ের মধ্যে বাড়িটা কেমন যেন বদলে গেছে। 

পচা: ছোটবেলা এখানে একবার এসেছিলাম। ওই যে দোতলার ভাঙা রেলিং টার কাছে কাউকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, এখনোও স্পষ্ট মনে আছে ভয় পেয়ে প্রাণ-প্রাণে দৌড় দিয়েছিলাম। 

শিবু: কিন্তু আজকে আর ভয় পেয়ে দৌড়াতে হবে না। তখন তোর বয়স কম ছিলো,  তাছাড়া তখন তোর সঙ্গে আমি ছিলাম না, চল এত ভাবতে হবে না, বাড়িতে ঢুকেই পড়ি। 

কথক  : শিবু আর পচা বাড়ির ভেতরে যেই ঢুকতে যাবে অমনি তখনই বাড়িটার এক পাশের একটা বড় নিম গাছ থরথর করে কেঁপে উঠলো । 

পচা: নিম গাছটা এমন ভাবে নড়ে উঠলো কেন বলতো ? গাছের মাথায় কি কিছু আছে ?

শিবু: ওদিকে তাকাবি না , তোকে বলেছি না,  যত বেশি ভয় পাবি ওরা তত বেশি ভয় দেখাবে,  চল চল এক তলার ঘর গুলোতে আগে ঢুকি। 

কথক ; ওরা নিম গাছের দিকে আর তাকালো না। লতা-বন পেরিয়ে একতলার ঘরের দিকে এগোতে লাগলো,  কিন্তু নিম গাছের ওপরে বসে কে যেন একটা আস্তে আস্তে মাথা বের করে দেখলে ওদের দিকে।


কাট 


সিন্ ৩
রাতের অন্ধকার । ঘরের ভিতর ।

শিবু; যাই বলিস এই ঘরে কিন্তু মানুষের পা অনেকদিন পরে নি , দেখেছিস ঘরের দরজা জানালা সব ভাঙ্গা , ঘরের মেঝেতে ধুলো ভোরে গেছে , আরে ওটা কি হচ্ছে ?

কথক : কথাটা বলতে বলতে শিবু পচা ওদের সঙ্গে আনা হ্যারিকেনের আলোয় দেখতে পেল সামনের ধুলোপড়া মেঝের উপর একটা একটা করে পায়ের ছাপ পড়তে শুরু করেছে।

পচা : এখানে কেউ আছে দেখছিস না পায়ের ছাপ ফেলে কেউ একজন জানালার দিকে চলে যাচ্ছে , ওই দেখ ওই দেখ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

শিবু ; চিন্তা করিস না,  কিছু হবে না,  কে ওখানে ?  কে ওখানে সাড়া দাও !  আমরা তোমার কোন ক্ষতি করতে আসিনি। আমরা শুধু তোমায় দেখতে এসেছি।
 
কথক ; শিবু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর কে যেন হেঁসে উঠলো। একটা মেয়েলি গলার হাসিতে চারপাশটা ভরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ীর বাইরের সেই নিম গাছটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠলো আরেকবার,  আর নিম গাছের নরম ডাল ভেঙে পড়ল নিচের দিকে। 

পচা: ওই দেখ সিড়ি দিয়ে কে যেন একটা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। 

শিবু : তাইতো। একটা মেয়ে বলে মনে হচ্ছে, সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠছে, চল চল আমরাও সিড়ি দিয়ে উপরের দিকে যাই। 

কথক : পচা শিবুকে থামাবার আগেই শিবু ছুটতে লাগলো সিঁড়ির দিকে,  কোন রকমে উপরে উঠে দোতলার বাকের কাছে আসতেই সে থম্কে দাঁড়িয়ে পড়ল। 

(ব্যালকনিটা এতো ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ।)

শিবু : ব্যালকনির শেষপ্রান্তে কেউ একটা দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু এখান থেকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।

পচা: শিবু শিবু নেমে আয় উপরে উঠিস না ! যত দুর্ঘটনা উপরের দোতলায় হয়েছে ! যে বা যারা গেছে তারাই বিপদে পড়েছে। 

শিবু; আমি শিবু । দোতলার ব্যালকনিতে না উঠে আমি এখান থেকে ফিরে যাবোই না, তাতে যা হবার হোক।

কথক : পচার কথা না শুনে শিবু এগোতে লাগলো দোতলার ব্যালকনির দিকে। ঠিক তখনই দেখতে পেল দোতলার ব্যালকনির  ঠিক কাছে এসে দাঁড়িয়েছে একটি ভয়ংকর মূর্তি।




#

ভূত : কে তোরা?  এখানে এসেছিস কেন ? জানিস না জানিস না এখানে আমি থাকি,  এখানে কেউ পা রাখেনা,  তোদের সাহস তো কম নয়। 

শিবু : আমাদের নাম তুমি জানো না,  জানলে আমাদের এই কথা বলতে পারতে না । আমাদের সাহস একটু বেশি,  ওই মুকুন্দপুর এর সাধু বাবা আমাদের সহায় আছে। সাধু বাবা যতক্ষণ আমাদের মাথার উপর ওনার আশীর্বাদের হাত থাকবেন,  ততক্ষণ আমাদের ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। 

ভূত: তাই নাকি ? তোরা একথাও জানিস না আমি এখানে ১০০ বছর ধরে রয়েছি, এ জায়গা আমার,  অন্ধকার নামার পর এখানে কেউ এলে তাকে আমি ছুঁড়ে ফেলে দিই ওই মাটিতে,  তারপর…হা হা হা হা হা হা। 

কথক : হাসতে হাসতে মূর্তিটা আরও বীভৎস হয়ে ওঠে, মূর্তিটার মাথার চুল হাওয়ায় উড়ছে, চোখের দৃষ্টি সাদা ফ্যাকাশে, মুখের ভেতর থেকে দাঁতের পাশ বেয়ে রক্ত নামছে। 

পচা: ওখান থেকে নেমে আয়,  ওখানে যাস না ওখানে যাসনা শিবু। 

শিবু;  আমি তোমায় ভয় পাই না ! যদি তোমার ক্ষমতা থাকে তাহলে তুমি আমায় মেরে দেখাও। 

ভূত;  এইটুকু বাচ্চা ছেলের এত বড় কথা ! তাহলে দেখ !  দেখ আমার ক্ষমতা…

কথক : এ কথা বলে সেই মূর্তিটা তার হাতটা লম্বা করলো, ব্যালকনির কাছ থেকে তার লম্বা হাতটা এগিয়ে এসে শিবুর গলার কাছটা চেপে ধরতে গেলো,  ঠিক তখনই একটা তীব্র চিৎকার করে মূর্তিটার হাতটা পেছনের দিকে সরিয়ে নিলো !

ভূত: কি হলো তোকে তোকে ধরতে পারলাম না কেন ? কেন ধরতে পারলাম না তোকে?

শিবু : আমার গলায় যতক্ষণ পর্যন্ত এই তাবিজ আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুতেই তুমি আমায় ধরতে পারবে না। এই গ্রামে আসার আগে মুকুন্দপুরের সাধুর কাছ থেকে এই তাবিজ আমি তৈরি করে নিয়ে এসেছি।

ভূত; তোকে ধরতে পারবো না,  কিন্তু পচাকে তো ধরতে পারবো। ও যাবে কোথায় ?

কথক: কথাটা বলে সঙ্গে সঙ্গে পেত্নিটি ব্যালকনি থেকে পচার দিকে যেতে লাগলো। সেই দেখে শিবু দৌড়ে পাচার কাছে যেতে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হুড়মুড় করে পচার গায়ের উপর পড়তেই হ্যারিকেনটা ভেঙে যায় ! তখন পেত্নিটি পচার গলা চেপে ধরে তাকে তুলে দিল শূন্যে।

শিবু; ওকে ছেড়ে দাও প্লীজ । আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে এখানে আসিনি , আমি এসেছি তোমায় মুক্তি দিতে। 

ভূত; তোরা মুক্তি দিবি আমায় ? হা হা হা! শোন এখন তোর বন্ধুকে আগে মারবো, আর পরে তোকে।  তোর ওই তাবিজ তোকে এখন বাঁচাতে পারবে কিন্তু ওকে তো পারবে না। 

শিবু : আমার কথা বিশ্বাস করো , তোমার মুক্তির জন্যই আমরা এখানে এসেছি। 

পচা: হ্যাঁ শিবু ঠিকই বলেছে, নয়ন দা আমাদের এখানে আসার কথা বলেছে যাতে যাতে তোমায় এখান থেকে মুক্তি দিতে পারি। 

কথক : বীভৎস মূর্তিটা কথাটা শুনে একটু থমকালো তারপর পচাকে আস্তে আস্তে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে বললো
 
ভূত: কি বলছিস, মুক্তি দিবি?

শিবু: হ্যাঁ দেবো । সাধু বাবা আমায় বলেছে সব আত্মারাই কোনো না কোনো কারণে আত্মা এই মায়ার পৃথিবীতে আটকে থাকে। তুমিও কোনো কারণে আটকে আছো, সে কারণ আমায় বললে আমি তোমায় মুক্ত করে দেবো। শুধু শুধু আমাদের ক্ষতি করো না প্লিজ।

ভূত: তুই যখন সে কথা বলছিস তাহলে তাই হবে,  তাহলে আয় আমার সঙ্গে নিম গাছের তলায় আয়। 



#

ভূত: আজ থেকে একশো বছর আগে আমি আমার স্বামী ও সন্তান কে নিয়ে এই বাড়িতে থাকতাম। একদিন এই বাড়িতে ডাকাত পড়লো । বাড়িতে এদিক ওদিক বোম পড়তে লাগলো। আমরা সবফেলে সন্তানকে নিয়ে চলেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি এতো কষ্টের অর্জিত টাকা গয়না লুট করে নিয়ে চলে যেতে দেব না বলে আমি আটকাতে গেছিলাম তাই ওরা আমায় মেরে ওই নিম গাছের তলায় মাটিতে পুতে রাখলো। বাড়ির সবাই চলে গেছিল তাই কেউ আমায় দেখতে পেল না। আমি আটকা পড়ে রইলাম ওখানে, স্বামী সন্তান আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। পরে এই বাড়িতে এখানে যারা এসেছে  সবার কাছে গেছি  আমার অন্তিম কিয়া সম্পূর্ণ করার জন্য বলি কিন্তু কেউ আমায় সাহায্য করেনি। সবাই ভয় পেয়েছে। আজ প্রথমবার তোরা সামনে থেকে আমায় সাহায্য করতে এলি,  আমায় মুক্তি দিবি বললি, আমার কঙ্কাল গ্রামের শ্মশানে পুড়িয়ে দিলেই আমি মুক্ত হয়ে যাবো ।
 
শিবু: বেশ ! তবে তাই হবে। 

কথক ; সেদিনের মত ওরা ফিরে এলো,  পরদিন সকালে নয়ন দা আর বাকি কয়েকজনকে নিয়ে নিম গাছের তলা থেকে খুঁড়ে বার করা হলো একটা কঙ্কাল। 

নয়ন: আমি জানতাম তোরা এখানে এলে কিছু না কিছু একটা হবে , তার জন্যই তো তোদের এখানে ডেকেছিলাম।
 
শিবু: আমিও এখানে আসার আগে মুকুন্দপুর এসে সাধুর কাছে গিয়েছিলাম,  সাধু আমায় অনেক কিছুই বলেছিলো,  আর একটা তাবিজও দিয়েছিল। 

নয়ন : তাহলে তোমরা কি বলো শিবু আর পচা এসেছিল বলেই আমাদের এই গ্রামের এত বছরের ওই দোতলা বাড়ির ভয় মুক্ত হল। থ্রি চিয়ার্স ফর শিবু আর পচা হিপ হিপ হুররে !

কথক ; এরপর মৃতদেহ শ্মশানে পুড়িয়ে দেওয়ার পরে পরশুদিন রাতেই দোতলা পুরনো ভাঙ্গা বাড়িটা হুরমুর করে ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল।





No comments

Powered by Blogger.