প্রেতপুরী

প্রেতপুরী

শৈলজানান্দ 

প্রেতপুরী



সিন ১-

(পুরনো রানিগঞ্জের সিন, কলিয়াড়ি এরিয়া, আশেপাশে মূলত টালির বাড়ি আর মাঝে মাঝে কিছু কোয়ার্টার টাইপ পাকা বাড়ি। আর ১-২টো চারতলা বাড়ি মেস টাইপের। সময়টা ১৯৬০-১৯৭০ সালের
বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যে নামব নামব করছে। এক ২৫-২৬ বছরের যুবক হেঁটে চলেছে। গলায় একটা স্টেথোস্কোপ দেওয়া যায়, যেহেতু লোকটা একজন ডাক্তার। কয়লার গুঁড়া বিছানো কয়লাকুঠির পথ। পথের উপর দিয়া মোটাসোটা বেঁটেগোছের এক ভদ্রলোক সাইকেল হাতে লইয়া পায়ে হাঁটিয়া চলিতেছিলেন, আর এক ভদ্রলোক তাঁহার কাছে আসিয়া নমস্কার করিলেন। সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। দূরে সাঁওতালী কুলি-ধাওড়া হইতে মাদল ও বাঁশির আওয়াজ শোনা যাইতেছিল।)

ডাক্তার (মোটা লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে) — নমস্কার। ম্যানেজার বাবুর বাসা কি এইটে ?
মোটা লোকটা— নমস্কার। আজ্ঞা না। এডা আমাদের কর্মচারীদের মেছ। আপনি বুঝি এহানে— এই কলিয়ারিতে নতুন ডাক্তার হইয়া আইলেন, না ? 
ডাক্তার— আজ্ঞে হ্যাঁ। কাল এসেছি।
মোটা লোকটা— কিসের লাগ্যা আইলেন মশাই? ভূতে যেদিন দেবে ঘাড়ড়া মটকাইয়া সেদিন বুঝবেন ঠ্যালা।
ডাক্তার— আজ্ঞে না, ভূত টুত আমি মানি না।
মোটা লোকটা— ভালো। আইয়া যখন পড়ছেন তো সাবধানে থাকবেন দাদা। ভূতের ভয়ে রাত্তিরে এহানে থাকতে পারি না মশাই। সাইকেল কইরা সেই সক্কালে আইছি আর এই চললাম। অন্ধকার হয়া এলো দ্যাহেন না!
(হাঁটতে হাঁটতে ২জনের কথা হচ্ছিল, একটা কোয়ার্টার বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে মোটা লোকটা বলবে)
মোটা লোকটা— এইডা ম্যানেজারের বাংলো। কড়া নাড়েন। অমি চললাম। নমস্কার। 

(সাইকেলের ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে লোকটা বেরিয়ে যাবে, ডাক্তার কড়া নাড়বে ম্যানেজারের দরজার)
(বাড়ির ভিতর হইতে) ম্যানেজার – কে?
ডাক্তার— দরজা খুলুন।
ম্যানেজার (দরজা খুলে বাইরে এসে) – ডাক্তারবাবু। আসুন, আসুন, রাত্তিরে এলেন যে? বসুন।
ডাক্তার— না আর বসবো না ম্যানেজারবাবু। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা কথা জিজ্ঞাসা করে যাই। আচ্ছা, ম্যানেজারবাবু শুনছি এখানে সবাই বলছে— ভূতের ভয়ে টিকতে পারবেন না। ব্যাপারটা কি বলুন তো মশাই?
ম্যানেজার (হাসিয়া) –  ভূত। হুঁ, সেকথা বলে বটে! বসুন তাহলে বলি।
ডাক্তার— বলুন। বসেছি।
ম্যানেজার – শুনুন। সে আজ থেকে অনেক দিনের কথা। বছর চার পাঁচ আগে। ভীষণ বর্ষা মশাই। চার পাঁচদিন ধরে সমানে বৃষ্টি। সিঙ্গারন নদীতে বান এল। হড়পা বান! ভাবলাম এমন কী আর হবে। আর ও তো প্রতি বছরই আসে। আমাদের আবার কাছেই সিঙ্গারন কিনা! দুনম্বর পিট-মাউথের পাশেই। সকালে একবার খাদের দিকে গেলেই দেখতে পাবেন!
ডাক্তার— দেখেছি। আপনি বলুন।
ম্যানেজার— দেখেছেন? বেশ, বেশ। ওই সিঙ্গারনই আমাদের সর্বনাশ করেছিল। দুপুরে খেয়ে দেয়ে চাপাচাপি দিয়ে একটুখানি শুয়েছিলুম। একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিলে—নদীর বাঁধ গেছে ভেঙে। সর্বনাশ। বাঁধ ভাঙলে আর রক্ষা আছে। তৎক্ষণাৎ ছুটতে ছুটতে খাদের মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। উঃ। নদীর সে কি মূর্তি মশাই। সিঙ্গারনের সেরকম ভয়ঙ্কর মূর্তি আমি ত কখনও দেখিনি। দেখলুম—হুড় হুড় হুড় হুড় করে খাদের মুখে জল ঢুকছে। সমস্ত নদীটা যেন খাদের ভেতর ঢুকে পড়তে চায়। বললাম, — চালাও পাম্প! কিন্তু একটা পাম্পের আর কতটুকু ক্ষমতা। এদিকে খাদের নীচে তখন জন-ত্রিশেক লোক । দুনম্বরের মুখ দিয়ে লোকগুলো যদি তাড়াতাড়ি উঠে আসতে পারে তবে মঙ্গল। লিফট-কেজ নীচে নামিয়ে রাখলাম। কিন্তু না, আধঘণ্টা পার হয়ে গেল, একটা ঘণ্টা গেল, দু ঘণ্টা গেল, কেউ আর উঠল না।
ঢালু সিমে' কাজ হচ্ছিল। জল গিয়ে সেখানেই জমেছে। বুঝলাম — কেউ আর বেঁচে নেই। প্রাণপণ চেষ্টায় নদীর বাঁধ বেঁধে পাম্প করে জল মারতে দুদিন লাগল। নীচে গিয়ে দেখলাম—সব শেষ। স্বামী স্ত্রীতে জড়াজড়ি করে উঠে আসছিল, তেমনি জড়াজড়ি করেই ডুবে মরেছে। বাপ ধরেছে ছেলেকে জড়িয়ে, মা ধরেছে মেয়েকে। ব্যস, সেই থেকে লোকের বিশ্বাস এতগুলো লোক যেখানে মরেছে সেখানে ভূত নিশ্চয়ই আছে। বুঝলেন? এই জন্যেই লোকে ভূতের কথা বলে, আর কিছু না।

ডাক্তার— (হাসিয়া) ও, এই!
ম্যানেজার – ( হাসিয়া) আজ্ঞে হ্যাঁ, এই।
ডাক্তার— যাক, এইটুকুই জানতে চেয়েছিলুম। চলি। কাল দেখা হবে।
ম্যানেজার— লণ্ঠন নিয়ে যান। বাইরে অন্ধকার যে।
ডাক্তার— না, আর লণ্ঠনের দরকার নেই। এই তো আম বাগানটা পেরিয়েই বাসায় গিয়ে পৌঁছোব। আসি। নমস্কার। ভূতের ভয় আমার নেই। তবু একবার জেনে গেলাম। জেনে রাখা ভাল। (হাসি) কি বলেন?

(ম্যানেজার (হাসি)। (দরজা বন্ধের শব্দ। মচ মচ করিয়া জুতার শব্দ। দূরে মাদল ও বাঁশি বাজিতেছিল। কোথায় যেন একটা কুকুর ডাকিয়া উঠিল। দূরের মাঠে শেয়াল ডাকিতেছে। বাগানের পথে শুকনো ঝরা পাতার উপর ডাক্তারবাবুর জুতার শব্দ। বাগানের ভিতর একটানা রোহিনী পোকার ডাক।)


সিন ২

(বাঁশ আর আম বাগানের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে ডাক্তার হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। দূরে কেউ একজন ছায়া ছায়া মতো চাদর মুড়ি দিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাথা অব্ধি চাদর টানা। মাঝে মাঝে দাঁত গুলো চকমক করে উঠছে দেখানো যায়।)

ডাক্তার— (হঠাৎ ভয় পাইয়া) কে? কে দাঁড়িয়ে ওখানে?
ছায়ামূর্তি— ডাক্তারবাবু! তুই একবার আয় আমার সঙ্গে।
ডাক্তার— কেন? কে তুই ?
ছায়ামূর্তি— আমি যেই হই না কেনে, তুর কি? তুই আয় আমার সঙ্গে।
ডাক্তার— কেন? কি দরকার ?
ছায়ামূর্তি— আয় বাবু, তুই না এলে আমার ছেলেটা মরে যাবেক।
ডাক্তার— কী হয়েছে কী তোর ছেলের?
ছায়ামূর্তি— তা জানি না বাবু। তুই দেখবি চল।
ডাক্তার— আচ্ছা চল।
(আবার শুকনো পাতার উপর দিয়া পায়ে চলার শব্দ। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাইতেছে।)
ডাক্তার— তোর নাম কিরে?
ছায়ামূর্তি— টুইলা মাঝি।
ডাক্তার— কত দূর যেতে হবে?
ছায়ামূর্তি— হোই ত! ওইখানে।
ডাক্তার— খাদে বুঝি তুই কয়লা কাটিস?
ছায়ামূর্তি— হঁ বাবু! উ সব জেনে তুর কী হবেক, চল।
ডাক্তার— ক'টি ছেলে তোর?
ছায়ামূর্তি— ওই একটি। আরও ছিল, তারা কেউ নাই।
ডাক্তার—ছেলেটি কত বড়?
ছায়ামূর্তি— তা অনেক বড় বটে!
ডাক্তার—তবু ক’বছরের?
ছায়ামূর্তি— কে জানে তো, অতসব জানি না।
(অনেকটা পথ হাঁটা হয়েছে, এবার একটু সন্দেহ হবে। ডাক্তার একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ছায়ামূর্তিটার মুখ দেখতে চাইবে কিন্তু কিছুতেই ছায়ামূর্তি অবধি পৌঁছোতে পারবে না, ও যত হাঁটার স্পিড বাড়াবে ছায়ামূর্তিও স্পিড বাড়াবে)
ডাক্তার— এ কী রে টুইলা? কাছে বলছিলি যে? পথ যে আর ফুরোতেই চায় না।
ছায়ামূর্তি— হঁ বাবু, কাছে লয় তো কী? চল বাবু, অমনি আমাকেও একটো ওষুধ দিবি।
ডাক্তার— তোর আবার কী হয়েচে?
ছায়ামূর্তি— তাই যদি বলতে পারব তাহলে ত আমিও তুর মতোন ডাক্তার হ’থম।
ডাক্তার— তাহলেও, বল না কী হয়েছে? জ্বর?
ছায়ামূর্তি— ন আ বাবু না, জ্বর টর কিছু লয়। খাদে বান ঢুকেছিল সেই থেকে ---
ডাক্তার— বান ঢুকেছিল? কখন রে? সে তো চার পাঁচ বছর আগে। অনেকদিনের কথা।
ছায়ামূর্তি— হঁ বাবু হঁ, এনেক দিন এগুতে।
ডাক্তার— তারপর?
ছায়ামূর্তি— তারপর? (একটু থেমে), আমরা তেখন এনেক কটা মজদুর ছিলাম খাদের নামুতে। হোই দিককার হোই নামু সুঁদটোতে কয়লা কাটছিলাম। (দূরে একটা কয়লার খাদানের বড় গর্তের দিকে আঙুল দেখিয়ে) হুড়মুড় করে শালা বানের জল একেবারে… হাতের লম্ফ-গুলা নিয়ে ভাবলাম ছুটে পলাই। কিন্তু পিথমেই লম্ফ গলা গেল নিমে। ঘুটঘুটে আধার হয়ে গেল। লে… এবারে কুন্দিকে যাবি… যা। পিথমে জল উঠল এক কুমোর, তাবাদে এক বুক, তাবাদে বাস…
ডাক্তার— সেখান থেকে তো কেউ বাঁচেনি শুনলাম। তুই বাঁচলি কেমন করে? (কিছুক্ষণের পজ, আনিদা টুইলার মুখটা দেখার চেষ্টা করছে) …চুপ করে রইলি যে? হ্যাঁরে এখানে না কি খুব ভূতের ভয়?
ছায়ামূর্তি— কে জানে ত!
ডাক্তার— আচ্ছা তুই সেই বান থেকে  বাঁচলি কেমন করে কই বললি না তো?
ছায়ামূর্তি— হঁ, বাঁচলাম আবার কুথা। আমি ত মরেই গেইছি।
ডাক্তার— সে কি রে!
(ডাক্তার এবার ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যাবে টুইলার দিকে, টুইলা উলটো দিকে মুখ করে খাদানটার দিকে তাকিয়ে আছে। টুইলার কাঁধে ডাক্তার যেই হাত দিতে যাবে, টুইলার শরীরটা ধুয়ো হয়ে হাওয়ায় মিশে যাবে)
ডাক্তার— তু… তু…। তুই টুইলা! টু…ইলা! কোথায় তুই? কোথায় গেলি?

(ডাক্তার জুতো টুতো ফেলে দৌর লাগাবে উলটো পথে। ছুটে পালাবার শব্দ ভেসে আসবে। দূরে কুকুর ডেকে উঠল তখন)



সিন ৩-

(ডাক্তারের কোয়ার্টার রুম। ঘরে একজন বয়স্ক কাজের লোক রয়েছে রামুদা)

রামুদা—হ্যাগো দাদাবাবু, শরীর ঠিক আছে তো? কাল রাত্তিরে অমন ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরে এলে, এসেই চাদর ঢাকা দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লে। কিছু খেলে না পর্যন্ত। আজ আবার এই ভোর চারটে বাজল, এখনও পর্যন্ত চোখে তোমার ঘুম নেই, শুয়ে শুয়ে ছটফট করছো, কি, ভাবছো কি বল দেখি?

ডাক্তারবাবু— ভাবিনি কিছু। হেড আপিসে আজ একটা দরখাস্ত করতে হবে। এখান থেকে
বদলি হয়ে যাব।
রামুদা— কেন, ভূতের ভয়ে?
ডাক্তার— না না ভূত কোথায়। ভূত কিসের? ভূত টুত নেই, তোমরা আবার যেন ভয় পেয়ো না। ও-সব কিছু না। বুঝলে?
(দরজার বাহিরে কড়া নাড়ার শব্দ, বাইরে থেকে ম্যানেজার হাঁক মারছে)
-ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!
ডাক্তারবাবু— এত রাত্তিরে কে ডাকে রে বাবা। বলে দাও আমি ঘুমিয়েছি। এ সময় কোথাও আমি যেতে পারব না। দরজা খুলো না, এইখান থেকে বলে দাও।
ম্যানেজার —ডাক্তারবাবু!
(রামু গিয়ে দরজা খুলে দেবে, দরজা খোলার শব্দ। ডাক্তারও উঠে এসেছে। ম্যানেজার ডাক্তারকে দেখতে পেয়ে ভিতরে ঢুকে আসবে।)
ডাক্তারবাবু— আরে ম্যানেজারবাবু। এত রাত্তিরে আপনি আবার কি জন্যে এলেন?
ম্যানেজার— আরে মশাই আর বলেন কেন? বিপদের ওপর বিপদ। খাদের নীচে খুন হয়েছে।
ডাক্তার— খুন! সে কি? রাত্রে খাদ বন্ধ থাকে তো। খুন কেমন করে হলো?
ম্যানেজার- সে সব অনেক কথা। জরুরি একটা অর্ডার পেয়েছিলাম, তাই ডবল হাজিরার লোভ দেখিয়ে মদ খাইয়ে নামিয়েছিলাম জনকতক লোক। শুনছি নাকি এক ব্যাটা খতম! চলুন, আর দেরি করে লাভ নেই। থানা থেকে ইন্সপেক্টর এসেছেন। চলুন।

(ম্যানেজারের পিছন থেকে টুকি মেরে দেখবে দরজার বাইরে একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে, পুলিশ অফিসারের ড্রেস-আপ পুরনো সময়ের হবে, এটা ১৯৫০-১৯৬০ সালের ঘটনা। )

ডাক্তার—চলুন।
(দরজার পাশে রাখা একটা কোট নামিয়ে গায়ে পড়তে পড়তে ডাক্তার ম্যানেজার ও অফিসারের সঙ্গে বেরিয়ে যাবে। অনেকগুলো পায়ের শব্দ। রামুদা গেটের ওখানে দাঁড়িয়ে হাত মাথায় ঠেকিয়ে বলবে দুগা দুগা)



সিন ৪-

(ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ডাক্তার, ম্যানেজার আর পুলিশ অফিসার ৩ জন একটা কয়লার খাদের কাছে এসে থামবে। বয়লারের সোঁ সোঁ শব্দ। দূরে কুকুর ডাকিতেছে, মনে হইল। কিছুটা বয়স্ক একটা মহিলা যেন কাঁদতে কাঁদতে আগাইয়া আসিতেছে। বয়স্ক মেয়েটা হচ্ছে গাংটুর মা। গাংটু যে খুন হয়েছে।)

গাংটুর মা— বাবু গো! খাদে আমার সব গেইছে বাবু! (কান্না)

ম্যানেজার— (চলিতে চলিতে) চুপ চুপ, গাংটুর মা, চুপ কর। কি আর করবি বল। 
গাংটুর মা— আমি একবার ছেলেটাকে দেখব বাবু, আমাকে নিয়ে চ।
ম্যানেজার— আমরা উপরে নিয়ে আসছি তাকে, তুই থাক এইখানে।
গাংটুর মা—গাংটু যে আমার জ্বর গায়ে খাটতে নেমেছিল বাবু। আমি তাকে বারণ করেছিলাম।

(খাদের মুখে একটা টেম্পোরারি লিফট মতো করা তার দিয়ে ঘিরে, আর কাঠের পাটাতন দিয়ে লিফটটা বানানো হয়েছে। ২ দিকে বড় বড় দড়ি কপিওকলের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। ওই দড়ি টেনে টেনে নীচ থেকে লিফটটা ওপরে ওঠানো বা নামানো হয়। খাদানের ওই লিফটের পাশে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে)

ম্যানেজার— আরে এই ব্যাকসম্যান, ঘণ্টি মারো। এ- খালাসি  ইঞ্জিন চালাও। চালাও। মারো ঘণ্টি।
( খাদানের পাশে দাঁড়ানো লোকটা পাশের একটা দড়ি ধরে তিনবার ঘণ্টা বাজাল। নীচে হইতে অনসেটার ঘণ্টায় জবাব দিল। লিফটকেজ ঝড়াৎ করিয়া উপরে আসিয়া থামিল। লোহার চেন আটকানোর শব্দ হইল। গাংটুর মা তখনও কাঁদিতেছিল। এবার ডাক্তার, ম্যানেজার, পুলিশ আর একজন হেল্পার লিফট কেজে উঠে এল। সর সর করিয়া লিফট কেজ নীচের দিকে নামিতে লাগিল। সোঁ সোঁ শব্দ করিতে করিতে লিফট-কেজ নীচে গিয়া থামিল। নীচে লিফটের মুখে অল্প অল্প করিয়া জল পড়িতেছে। ঝড়াং করিয়া চেন খুলিবার শব্দ। নীচে লিফটের পাশেই একটা লম্ফ জ্বলছিল, মুনিয়া সেটা হাতে নিয়ে সবার আগে আগে যেতে লাগল।)

ম্যানেজার— এইদিকে আসুন ইন্সপেক্টরবাবু, চলরে মুনিয়া, তুই আগে আগে চল। ইন্সপেক্টরবাবু, আপনার হাতের টর্চটা জ্বালুন।

(জল-সপসপে পথের উপর ট্রাম লাইনে হোঁচট খাইয়া খাইয়া সকলে আগাইতে লাগিল। ঝিঁঝি পোকার চিরিক চিরিক শব্দ। কোথায় যেন একটা কোলা ব্যাং ডাকিতেছে।... ডাক্তার সবার পিছনে হাঁটছে। হঠাৎ ডাক্তারের মনে হল তার পিছন দিকে কেউ যেন একটা ঝট করে সরে গেল, কিছুক্ষণের জন্য ভয়ে থেমে থাকল ডাক্তার, আসতে আসতে ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরে তাকাল। দেওয়ালে একটা ছায়া দেখে ভয় পেয়ে চমকে উঠল। পরে দেখল মুনিয়ার হাতের লম্ফের আলোয় ডাক্তারের নিজের ছায়া পড়েছে দেওয়ালে। ডাক্তার আবার দ্রুত পা চালিয়ে বাকিদের পিছনে আসবে। সেই সময় কিছু একটা ডাক্তারের পা যেনে চেপে ধরল। )
ডাক্তার— ওরে বাবারে!
(ডাক্তার লাফিয়ে উঠল)

ম্যানেজার— কি কি, কি হলো ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার— এই দেখুন না মশাই, কেউ যেন আমার পা আকড়ে ধরতে চাইছিল …
ম্যানেজার – সর্বনাশ। 
ইন্সপেক্টর— (টর্চ জ্বালিয়ে চারিদিক দেখল, ডাক্তারের থেকে একটু দূরে ২-৪টে ইদুর নিজেদের মধ্যে মারামারি টাইপ করছে। এবার সে হাসিয়া বলল)  শেষ-মেষ ইঁদুরে ভয় পেয়ে গেলেন? আসুন। আপনি আমাদের মাঝখানে আসুন।
ডাক্তার— আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই ভালো। (ডাক্তার ভয়ে ভয়ে ওদের মাঝে এসে দাঁড়াবে।)
ইন্সপেক্টর— লোকটা কখন মরেছে?
ম্যানেজার- রাত্রেবেলা… না মানে বিকেলবেলা। কাজ শেষ করে ওঠবার সময়। ব্যাটা চুরি করে Hanging Coal এ চোট মেরে ছিল আর কি!
ইন্সপেক্টর— বয়েস কত?
ম্যানেজার— বেশি বয়েস নয়। Young man.
ইন্সপেক্টর— সাঁওতাল ?
ম্যানেজার— আজ্ঞে হ্যাঁ। সাঁওতাল।
ইন্সপেক্টর— মা তো দেখলাম ওপরে কাঁদছে। বাপ নেই?
ম্যানেজার— না, বাপটা সেই ত্রিশ সালের বান যখন ঢুকেছিল খাদে তখন মরেছে।
ডাক্তার— বাপের নাম কি ছিল বলতে পারেন?
ম্যানেজার— বাপের নামটা... আমার ঠিক... হাঁরে মুনিয়া, তুই জানিস ?
মুনিয়া—  কার? গাট্টুর বাপের নাম? টুইলা মাঝি।

ডাক্তার– কি বললি? টুইলা মাঝি? (মনে মনে আউড়াবে কথাটা ডাক্তার। তার কিছুক্ষণ পরে সামনে চেয়ে দেখবে বাকিরা আবার কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে, ডাক্তার পা ঝাড়তে ঝাড়তে চেচিয়ে উঠবে) আঃ, ইদুর-আরসুলাগুলো কিরকম জ্বালাতন করছে দেখেছেন? ও মশাই, আপনারা আবার আমাকে পেছনে ফেলে দিলেন কেন? আমি মাঝখানে যাব। আমার ভয় করছে।

ইন্সপেক্টর— ভয়? (সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল )
(কিছুটা যাওয়ার পর একজায়গায় থেমে সামনের দিকে মেঝেতে আঙুল দেখিয়ে মুনিয়া বলবে)
মুনিয়া— বাবু লাশ ত এখানে ছিল। কই নাই ত'?
ম্যানেজার - সে কি রে? নেই কি রকম? লাশ যাবে কোথায়? দ্যাখ ভালো করে।
মুনিয়া—না বাবু, এই ত এই কাঁথির কাছে দেখে গেলাম, এই ত রক্তের দাগ। আচ্ছা, দাঁড়ান বাবু! আমি একবার ওই দিকটা দেখে আসি।
ডাক্তার- ব্যাটার সাহস ত খুব!
ম্যানেজার – কেন, আপনার কি ভয় করছে নাকি?
ডাক্তার—না মশাই, ভয়-ডর আমার ছিল না, কিন্তু কাল থেকে…
ইন্সপেক্টর— কাল থেকে কী?

(হঠাৎ একটা বিকট চিৎকার! যেন কোন পিশাচ চেচিয়ে উঠেছে। সেই আওয়াজটা একটু থামতেই মুনিয়া ভয়ে চেচিয়ে উঠবে---)

মুনিয়া— ওরে বাবারে, বাবু, বাবু, বাবু, পেয়েছি..... (সকলে ছুটিয়া তাহার কাছে গিয়া দাঁড়াবে) এই ত লাশ।

মুনিয়া— লাশটার পেটেই পা দিয়ে ফেলেছিলাম বাবু। মড়াটা চেঁচিয়ে উঠল। আপনারা শুনতে পেলেন না?

ম্যানেজার— দূর ব্যাটা! মড়া আবার চেঁচায় নাকি? তুই নিজেই চেঁচিয়েছিস ভয়ে।
মুনিয়া—  কিন্তু এ কি বাবু, আলোটা যে নিবে গেল। (হাতের লন্ঠনটা নিবে যাবে)
ম্যানেজার—জ্বালা। জ্বালা! এই নে দেশলাই। ইন্সপেক্টরবাবু আপনার টর্চটা....
ইন্সপেক্টর— আমি ঠিক আছি। আমার টর্চটাও হঠাৎ নিবে গেল… (ইন্সপেক্টর হাত দিয়ে টর্চটা ঠুকে জ্বালাবার চেষ্টা করছে)

(দেশলাই জ্বালানোর শব্দ, ম্যানেজার দেশলাই জবালাবার চেষ্টা করছে। দুটো, তিনটে, চারটে )
মুনিয়া— না বাবু। এ আলো জ্বলবে না।
ইন্সপেক্টর— সে কিরে? বাঃ, এ কি রকম? আমার টর্চটাও যে নিবে গেল।
ডাক্তার—ব্যস। নে এইবার মর এইখানে। এবার কী হবে? চলুন হাতড়ে হাতড়ে কোনোরকমে খাদের মুখে ফিরে যাই। আমার মশাই ভয় করছে।
মুনিয়া—আসুন বাবু, তাহলে আমার পিছু পিছু আসুন।

(হঠাৎ নাকি সুরে একটা আওয়াজ ভেসে আসবে )
টুইলার ভূত- যাবি কুথা? আমার ছেলেকে বাঁচা এগুতে, তাবাদে যাবি।
(সবাই ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখবে একটা ছায়ামূর্তি চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা আগের দিনের টুইলা মাঝির ভূত। চোখ ২ টো একটু লাল হয়ে জ্বলছে দেখানো যায়।)
ম্যানেজার— কে তুই?
ডাক্তার— সর্বনাশ! এ যে সেই টুইলার গলার আওয়াজ!

(হঠাৎ একটা হাওয়া উঠবে, সকলে হাত দিয়ে মুখ গার্ড করে হাওয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। ইন্সপেক্টর এবার আবার টর্চ ঠুকে জ্বালাবার চেষ্টা করবে এবার জ্বলবে টর্চটা। টর্চটার আলোটা ইন্সপেক্টর টুইলার ভূতের দিকে ফেলবে , দেখবে সেই হাওয়ায় টুইলার গায়ের চাদর উড়ে যাবেয়ার একটা হাড়-কঙ্কাল ভূত বেরিয়ে আসবে। ভূতটার নীচের দিকটা ধুতি পরা। হাওয়া এবার কমে আসবে। সবাই ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে ওদিকে। ডাক্তার ভয়ে কাঁপছে। মুনিয়া পাশের কয়লার একটা বড় চাং পড়ে ছিল, তার পিছনে লুকিয়েছে।)

ম্যানেজার— আপনার কাছে রিভলভার ছিল না ইন্সপেক্টরবাবু?
ইন্সপেক্টর— হ্যাঁ (ইন্সপেক্টর কোমর থেকে রিভিলিভার বের করে ফায়ার করবে। রিভলভারের আওয়াজ)—
টুইলার ভূত — বটে! আমাকে গুলি করবি? (হো হো করিয়া হাসির শব্দ। তার পরে টুইলার ভূতের কঙ্কালের হাতটা বড় হতে হতে গিয়ে ইন্সপেক্টরের কান ধরবে। দিয়ে কান ধরে টানতে টানতে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। ) -
ইন্সপেক্টর—বাবরে! গেলাম, গেলাম। ছেড়ে দে বাবা, ছেড়ে দে। আর আমি গুলি ছুঁড়বো না, ছেড়ে দে আমি পালাচ্ছি।
টুইলার ভূত — গুলি চালাবি আর? চালা। দেখি কেমন মরদ।
ইন্সপেক্টর- না বাবা। আর না আর না-
টুইলার ভূত — হাড় বজ্জাত ইনিসপেকটর। আমাদের বেপদ আপদে ত তুর টিকি টোরও দেখা পায় না। তবেক ম্যানেজার ডাকলি চলি আসিস আমদের প্যাঁদাতে। ঘটি-বাটি টোও পরযন্ত কাড়ি লিস। থাক তুই এইখানে। কই তুদের ম্যানেজার কই ?

ম্যানেজার — এই যে বাবা! আমি বাবু দোহাই বাবা-
(টুইলার ভূতের অন্য কঙ্কাল হাতটা বাড়িয়ে ম্যানেজারের জামার কলার ধরে ওকে মাটি থেকে উপরে তুলে নেবে) -
 টুইলার ভূত —  আচ্ছা! তুখে ছেড়ে দিব! আমাকে মেরেছিস বানে ডুবোঁই—জলের ভিতর ইঁদুর মারা করে। বড় ছেলেটো সেই সঙ্গে গেইছে, তাবাদে এই ছুটু ছেলেটো ছিল তাখেও দিলি তুরা মেরে। 
(টুইলার ভূত এদিক ওদিক দেখতে দেখতে) —  কই, সেই ডাক্তারটো কই?

ডাক্তার– আঃ। এই যে বাবা আমি।
টুইলার ভূত — আয় দ্যাখ যদি তুই বাঁচাতে পারিস। কাল ছেলেটোর জ্বর হয়েছিল- সেই যে তুখে বললাম আম-বাগানে। জ্বরে জ্বরেই পয়সার লোভে এসেছিল কয়লা কাটতে। আয় দেখবি আয়।

ডাক্তার— ও আর কি দেখব টুইলা? মরা মানুষ বাঁচাতে ত আমরা পারি না।
টুইলার ভূত — ও। আচ্ছা, যা তবে তুরা পালা ইখান থেকে। আমি একাই রইলাম এইখানে গাংটুকে আগুলে। 
(ইন্সপেক্টর এর কান ধরেছিল টুইলা এবার কান ধরে জোরে ওকে দূরে ছুঁড়ে দিল, ইন্সপেক্টর খাদানের দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ল মেঝেতে। অন্যহাতে ম্যানেজারের কলার ধরে মাটির উপরে তুলে রেখেছিল টুইলা। এবার ইন্সপেক্টরকে ছুঁড়ে ফেলে সেই হাতে ম্যানেজারকে ৩-৪ টে থাপ্পর মারবে তারপর কলার ছেড়ে দেবে। ম্যানেজার থপ করে নীচে পড়বে। কঙ্কালটা এবার পাশের একটা পাথরের চাঙের উপর বসে দুঃখ দুঃখ করে বলবে --)
টুইলার ভূত —যা তুরা পালা। আমি একাই রইলাম এইখানে গাংটুকে আগুলে। 
ডাক্তার— কিন্তু ওর মা যে ওকে একবার দেখতে চাচ্ছে রে! তাদের ওপরে দেখে এলাম কাদছে।

টুইলার ভূত — কাঁইদছে! ই তা কাঁইদবেক আমি জানি। ওর আর কেই বা রইল এই সংসারে? (গলার আওয়াজ তাহার ভারী হইয়া আসিল টুইলার, এবার ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে) দ্যাখ—হেই ম্যানেজার, আমাদের সবাইকেই ত সাবাড় করেছিস তুই। এবার ওই বুড়িকে যদি না মারিস ত তুখে দিব্যি রইলো। বুঝলি? (ম্যানেজার মেঝেতে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। টূইলা এবার উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে গাট্টর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে)  কই রে গাট্টু আর কুনো সাড়া দিচ্ছিস লাই যে, কিছু তো বল। গ্যাট্টু। গ্যাট্টু। (কান্নাকাতর কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে টুইলার কঙ্কাল পিছন দিকে হাঁটতে হাঁটতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।)

(শেষ)

No comments

Powered by Blogger.